বুধবার, ১৬ মে, ২০১৮

দেশান্তরী নন্দীরা

পিতার নাম মথুরানাথ নন্দী। মাতা প্রিয়তমা। মথুরানাথ চাকুরি করতেন পুলিশে। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাঁর আগ্রহ ছিল। ১৯১০ সালে ফেনীতে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মন্মথনাথ নন্দীর জন্ম।  ১৯৩৫ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ডাক্তারি পাশ করেন। বিহারের ভূমিকম্পের পর সেনাবাহিনীর পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তার হিসেবে কাজ করেন। তারপর সার্জন হিসেবে যোগ দেন  কলকাতার আর. জি. করে। পরে রেজিস্ট্রার হন সেই হাসপাতালের।
১৯৩৯ সালে বিক্রমপুরের ভাগ্যকূলের জমিদার কুন্ডু পরিবার শ্রীনগরে ছোট একটি হাসপাতাল খোলার উদ্যোগ নেন। ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে তাঁরা অনুরোধ জানান, গ্রামের সেই হাসপাতালের জন্য একজন ডাক্তারের খোঁজ দিতে। ডা. রায় মন্মথনাথ নন্দীর নাম প্রস্তাব করেন। কুন্ডুরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর তখন লন্ডন যাওয়ার কথা উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু প্রস্তাব পেয়ে ঠিক করলেন, গ্রামের সেই হাসপাতালেই দরিদ্রজনের সেবা করবেন। ১৯৩৯ সালে যোগ দেন শ্রীনগরের হাসপাতালে। হাসপাতালের নাম ছিল রাজা শ্রীনাথ হাসপাতাল।এই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়।
১৯৪৭ সালে ডা. নন্দী মাতৃভূমি ত্যাগ করেননি, বরং পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে সরকার তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালে বদলি করে। ঢাকায় এসে  যুগীনগরে তিনি বাসা নেন।
এখনকার পুরানো ঢাকার অর্থাৎ তখনকার ঢাকার ঠাটারীবাজার, যুগীনগর, বনগ্রাম, ওয়ারী, র‌্যাংকিন স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট আর হেয়ার স্ট্রিট একসময় ছিল ঝকঝকে উজ্জ্বল, পরবর্তীতে  প্রতিষ্ঠিত ও সৃজনশীল সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, শিল্পী ও লেখকের পিতামাতার বাসস্থান, বেড়ে ওঠার অলিগলি চৌকাঠ।
সৈয়দ আবুল মকসুদের অবলোকনে পাই, ১৯৫২-র গ্রীষ্মকালে প্রথমবার ঢাকায় এসে নারিন্দা, ওয়ারী, ফরাশগঞ্জ, পাটুয়াটুলী, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর, চকবাজার, লালবাগে হিন্দু-মুসলমানের একটি যৌথ সমাজ দেখেছি। বিকেলবেলা ইসলামপুরের দোতলা বাড়িগুলোর ঝুলবারান্দায় দেখতাম হিন্দু মহিলারা বসে গল্প করছেন। প্রবীণ মহিলাদের কেউ তাঁদের কন্যা বা নাতনির চুল বেণি করে দিচ্ছেন। হেঁটে বা ঘোড়ার গাড়িতে আমরা রাস্তা দিয়ে যেতাম। নির্মল সামাজিক পরিবেশ। বড় ভালো লাগত। ষাটের দশক নাগাদ সেই সামাজিক পরিবেশ আর রইল না। নবাবপুরের দোতলা বাড়ির বারান্দায় আর দেখা যেত না ধোপদুরস্ত কাপড় পরা হিন্দু নারীদের।
প্রথম ঢাকায় এসে আব্বার সঙ্গে দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে যেতাম। লালবাগ কেল্লা, বড় কাটারা, ছোট কাটারা, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল, হাজি শাহবাজের মসজিদ, রমনা কালীমন্দির, হাইকোর্টের প্রাঙ্গণে হজরত চিশতি বেহেস্তির মাজার প্রভৃতি। হাজি শাহবাজের মসজিদ থেকে কালীবাড়ির মন্দিরের দূরত্ব আড়াই শ গজ। কী করে দুই ধর্মাবলম্বীর দুটি উপাসনালয় অত পাশাপাশি থাকতে পারে, তা নিয়ে তখন ভাবার প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণ, বাঙালি সমাজে, বাঙালির সমন্বিত সংস্কৃতিতে তা ছিল স্বাভাবিক।''
''হঠাৎ কিসের মধ্যে কী হলো, ১৯৬৪ সালে দেখা দিল উত্তেজনা। আমরা তখন থাকতাম আজিমপুর কলোনির পাশে লালবাগ শাহি মসজিদের কাছে। বৃহত্তর লালবাগ-শেখ সাহেব বাজার, আমলীগোলা, চৌধুরী বাজার, জগন্নাথ সাহা রোড, শ্রীনাথ স্ট্রিট প্রভৃতি এলাকায় অনেক হিন্দু মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ী বাস করতেন।
লালবাগ ঋষিপাড়া প্রভৃতি এলাকায় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা থাকতেন। তফসিলি হিন্দুদের পেশা ছিল জুতা-স্যান্ডেল বানানো। ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুবিরোধী পৈশাচিকতা দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দল ও গোষ্ঠীর তাতে থাকে মদদ। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতারা বসে রইলেন না। তাঁরা রাস্তায় নামলেন।
কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরাও ঘরে বসে রইলেন না। বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, কবি জসীমউদ্দীনসহ অনেকেই হিন্দুদের জানমাল রক্ষায় রাস্তায় নামলেন। তাঁরা রাস্তায় লিফলেট বিলি পর্যন্ত করলেন। আমাদের মতো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব নিল।
সন্ধ্যার আগে খেয়েদেয়ে আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে হিন্দুদের বাড়িঘর, ঋষিপাড়া প্রভৃতি সারা রাত পাহারা দিতাম। এসএম হল ও ফজলুল হক হলের ছাত্ররা জগন্নাথ হলের ছাত্রদের নিরাপত্তায় অতন্দ্র জেগে থাকতেন। মনে আছে, একদিন রাত ১২টা/১টার দিকে রাশেদ খান মেননের শ্বশুর কেরামত আলী সাহেব ও পাড়ার কয়েকজন মুরব্বি কেল্লার মোড়ে আমাদের দেখতে আসেন ঠিকমতো পাহারা দিচ্ছি, নাকি পাহারা দেওয়ার নাম করে কোথাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর শাসকশ্রেণির মধ্যে ভারত-বিরোধিতা থেকে হিন্দু বিরূপতায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। যুদ্ধটা হয় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে, মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে নয়। কিন্তু পাকিস্তানে হিন্দুরা এবং ভারতে মুসলমানরা সন্দেহভাজন নাগরিকে পরিণত হন। যাঁরা ওই সময় কোনো কারণে দেশের বাইরে ছিলেন, তাঁদের সম্পত্তি রাষ্ট্র নিয়ে নেয়। শুধু তা-ই নয়, সে সম্পত্তির নাম দেওয়া হয় এনিমি প্রপার্টি, যার বাংলা ‘শত্রুসম্পত্তি’।
দেশভাগের রায়টের পর আবারো ১৯৫০ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, যুগীনগর ও আশেপাশের এলাকার হিন্দু পরিবারগুলি ডা. নন্দীর বাসায় এসে আশ্রয় নিতো । তাঁর অজান্তেই তাঁর নামযশের কারণে তিনি অলিখিতভাবে অসহায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিভাবকে পরিণত হন। দাঙ্গার সময় মোহামেডানের বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় আববাস মির্জা ও রাজনীতিবিদ শামসুদ্দিন ডা. নন্দীর বাসা পাহারা দিয়ে রাখেন।
ওই সময় (১৯৫০) সরকার তাঁকে ফরিদপুরে বদলি করলে তিনি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং তা জমে উঠতে সময় নেয়নি। ১৯৫৩ সালে তাঁর  জ্ঞাতিভাই ভবেশ নন্দী এমএনএর ৩৭নং র‌্যাংকিং স্ট্রিটের বাড়িটি তিনি কিনে সেখানে উঠে যান।
র‌্যাংকিন স্ট্রিটে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে কমপক্ষে রাত দশটা অবধি তিনি রোগী দেখতেন বা রোগীর বাসায় যেতেন। তাঁর হাতযশের খবর এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ভোর থেকে তাঁর বাসার সামনে রোগীদের লাইন পড়ে যেত। রোগীদের ফি ছিল পাঁচ টাকা। একই রোগের জন্য রোগীর কাছ থেকে বারবার ফি নিতেন না। নিজের বাসায় অপারেশন থিয়েটার করে নিয়েছিলেন। তাঁর অস্ত্রোপচার দেখার জন্য মেডিক্যালের ছাত্ররা আসতেন।
পঞ্চাশের দশক থেকেই ওয়ারির ডা. নন্দীর বাসাটি ঢাকার সংস্কৃতি জগতের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। নাচ, গান, নাটকের মহড়া চলত সেখানে নিয়মিত। আসতেন সেখানে পরবর্তীতে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অজিত কুমার গুহ, সানাউল হক, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ অনেকে। সে-সময়ের তরুণ লেখক সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ ছিলেন নন্দী-পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য নেতাও আসতেন সে-বাসায় নিয়মিত। আশ্রয় বা আলোচনা/ পরামর্শের জন্য। যেমন খোকা রায়, নেপাল নাগ, মোহাম্মদ তোহা বা অলি আহাদ।
শেরেবাংলা ফজলুল হকের ছিলেন  তিনি ব্যক্তিগত চিকিৎসক। মওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব তাঁকে ডাকতেন দাদা বলে,  গোপন রাজনৈতিক দলের নেতাদের আশ্রয় ছিল তাঁর বাসা।
শ্রদ্ধাস্পদ সম্পাদক সাংবাদিক আবুল হাসনাতের লেখাতে পাই, ''কত খ্যাতিমান ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ জীবন অতিবাহিত করেছেন এ-এলাকায়। সরকারি আমলা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবহারজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক আর অনেক সাংবাদিকের বাসস্থান ছিল সেখানে। প্রতিটি গৃহে বৃক্ষ ও বাগানের পরিচর্যা ছিল। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সন্ধ্যায় মিলিত হতেন এখানে। সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যেত অনেক বাড়ির অন্দরমহল থেকে। দূর থেকে দেখতাম রাজনীতিবিদ ভবেশ নন্দীকে, নিরহংকার, সদাব্যস্ত, পরোপকারী। দরিদ্র মানুষকে সর্বদা সহায়তা করতেন।
বোধকরি র‌্যাংকিন স্ট্রিটে তাঁর আপিস ছিল ও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোত। ২ হেয়ার স্ট্রিটে একদা ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ ও ডাকসাইটে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী। র‌্যাংকিন স্ট্রিটে ছিলেন অ্যাডভোকেট সবিতা রঞ্জন পাল, ব্যবহারজীবী ও পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদ সুধাংশু শেখর হালদার, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য ও খ্যাতিমান রসুল সাহেব। রসুল সাহেবের বাড়ির বৃহৎ প্রাঙ্গণে তাঁর দুই সন্তানসহ রেঞ্জার্স ক্রিকেট ক্লাবের খেলোয়াড়রা নেট প্র্যাকটিস করত। চলিস্নশের দশকে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনরা ছিলেন লারমিনি স্ট্রিটে।
বাবা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কাছেই ছিলেন তারাবাগে কবি সুফিয়া কামাল। আজকের খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসানরা ওয়ারীর সন্নিকটে পিতৃগৃহে বাস করতেন।ডা. মন্মথনাথ নন্দী,  অনুরোধ এলেই যখন-তখন গভীর রাতেও রোগী দেখতে বাড়ি বাড়ি যেতেন। এভাবেই তিনি ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তের হৃদয়ের মণি ও গৃহের চিকিৎসক হয়ে উঠেছিলেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সপ্তাহে একদিন ডা. নন্দী শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও দরিদ্র মানুষকে বিনা ভিজিটে চিকিৎসার বিধান লিখে দিতেন। স্ত্রী শান্তি নন্দী নারী শিক্ষা মন্দির বিদ্যায়তনের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ।
র‌্যাংকিন স্ট্রিট সংলগ্ন যুগীনগরে আমি বড় হয়েছি। ঢাকার জনপ্রিয় মানবহিতৈষী ডা. মন্মথনাথ নন্দীও একসময়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করতেন এখানে। কিছুদিন যুগীনগরে বাস করার পর তাঁরা চলে যান র‌্যাংকিন স্ট্রিটে, সুরম্য একটি দ্বিতল বাড়িতে; ডাক্তার নন্দীর চেম্বার ছিল এই বাড়িটিতে। তৎকালীন বাংলাদেশের উদার ও মুক্তমনা শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংগীতশিল্পীদের মিলনে ও সম্মিলনে মুখরিত হয়ে উঠত এ-বাড়ি। অনেক রোগীরই শেষ ভরসা ছিলেন ডা. নন্দী''।
কতটা সম্পৃক্ত  ছিল নন্দী পরিবারের ? বাঙালি রাজনীতিবিদ, লেখক, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর স্বনামধন্য পুত্র   ইকবাল বাহার চৌধুরীর একটি স্মৃতিচারণ। ‘১৯৬১ সালে মহাসমারোহে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। সরকার সেই সময় এই উৎসবের ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী ছিল না, বরং নানাভাবে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঢাকার ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে কয়েক মাস ধরে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়।
শতবর্ষ পালনের জন্য, যতদূর মনে পড়ে তিনটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়। বিচারপতি এস এম মোর্শেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি প্রথম ২৫ বৈশাখ অনুষ্ঠান শুরু করে। এই কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ। রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে বুলবুল একাডেমী যথাক্রমে চণ্ডালিকা এবং চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেছিল।
২৫ বৈশাখ চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্য হওয়ার ঠিক আগে, ২৮ এপ্রিল বাফার শিক্ষক ভক্তিময় দাশগুপ্তের পরিচালনায় এই নৃত্যনাট্যের প্রথম অংশ ঢাকার কার্জন হলে মঞ্চস্থ হয়। উদ্যোক্তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডাকসু)। আমিনুল ইসলাম তখন ডাকসুর ভিপি আর আমি কমিটি মেম্বার।
চণ্ডালিকায় প্রধান দুই চরিত্রে নৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন – মন্দিরা নন্দী (ডাক্তার নন্দী কন্যা ) ও সেলিনা বাহার। সংগীতে প্রকৃতির ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছিল হামিদা বানু (বুলু)। প্রকৃতির মায়ের গানগুলো গেয়েছিল শিরিন বেগম (শীলা), তখনকার প্রবীণ সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাবেবরের মেয়ে।এরপর শ্যামা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হলো সফলভাবে। ড. নন্দী আর শান্তি নন্দীর বাড়িতে চলে রিহার্সাল। শ্যামা হয়েছিল মন্দিরা নন্দী আর বজ্রসেন কামাল লোহানী। উত্তীয় সেজেছিল দুলাল তালুকদার। শ্যামার গান গেয়েছিলেন ফাহমিদা খাতুন আর জাহেদুর রহিম বজ্রসেনের গান করেছিলেন। জাহেদুর রহিম সম্ভবত ভক্তিময় দাশগুপ্তের হাতে তৈরি সবচেয়ে গুণী ও ভালো ছাত্র।’
বনগ্রাম, যুগীনগর ও ঠাটারীবাজার। পরে ভারতের বিহার ও অন্যান্য অঞ্চলের উদ্বাস্তুরা  ছলে-বলে ও কৌশলে হিন্দু  সম্পত্তি, বাড়িঘর দখল করে নিয়ে এই তিনটি অঞ্চলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করেছিল । অনেকে নীরবে-নিভৃতে-প্রচ্ছন্নে কাউকে না জানিয়ে ভিটামাটি ত্যাগ করে চলে যান ভারতে।
তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খাঁর পরিকল্পনা ও নির্দেশে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। শুধু ঢাকা নয়, ডেমরা ও সাভার ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। গভর্নর মোনায়েম খাঁ পরিকল্পিতভাবে আদমজী জুট মিল ও বাওয়ানী জুট মিলের শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে  হিন্দু নিধনে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল।
পঞ্চাশের দাঙ্গার পর এই দাঙ্গাটি ছিল ভয়াবহ। মানুষ ক্ষতির পরিমাণও ছিল সর্বাধিক। সে-সময়ে উন্মত্ত-সংগঠিত শতসহস্র মানুষকে ছুরি ও মারণাস্ত্র হাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি লুট ও মানুষ হত্যা করতে দেখা গেছে । ঢাকায় দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে গিয়ে দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত হয়েছিলেন লেখক আমির হোসেন চৌধুরী।
১৯৬৪ সালে রায়ট শুরু হলে সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ ডা. নন্দীর  বাসায় গিয়ে বললেন, তাঁকে তাঁর সঙ্গে যেতে হবে। বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি ফয়েজ আহমদের দিকে তাকালেন : ‘রায়ট ! আমাকে হত্যা ? আমার এ-বাড়িতেই আমি প্রাণ দেব। আমি তো হিন্দু-মুসলমানের কিছু বুঝি না।’
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের বরাত দিয়ে উঠে আসে, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন সস্ত্রীক ডা. নন্দী গিয়েছিলেন লুধিয়ানায়। তাঁর দুই ছেলে সপরিবারের এক মোটর দুর্ঘটনায় আহত হন। লুধিয়ানার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাদের। পাকিস্তানি সরকার তাঁকে ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ শুরু করে। যিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করেননি, যাঁর কাছে হিন্দু-মুসলমান ছিল শুধু মানুষ, যিনি চিরদিন মানুষের সেবা করেছেন, যাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারই রাষ্ট্রীয় উপাধি দিয়েছে, তাঁকেই শত্রু  হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।  ডা. নন্দীর বাড়িঘর সম্পত্তি সব শত্রুসম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এক নিমেষে তিনি  কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন ।
'ঢাকা ত্যাগ করা মানে ছিল শিকড় ছিঁড়ে যাওয়া। এই চলে যাওয়া ডা. মন্মথনাথ নন্দীকে মনের দিক থেকে আর থিতু করেনি। যে মানুষটি ঢাকার চিকিৎসাজগৎ ও সাংস্কৃতিক ভুবনে অপরিহার্য ছিলেন, রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে এক বস্ত্রে শিকড় ছেড়ে চলে গেলেন ভারতে' !
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকার অনেকে ডা. মন্মথনাথ নন্দীর ও তাঁর কন্যা-পুত্রদের আশ্রয়ে থেকেছেন । তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করছে ।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু কলকাতা সফরে যান। তখন বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে তাঁকে একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় –  দাদা-বউদি যেন ঢাকায় ফিরে তাদের র‌্যাংকিন স্ট্রিটের বাসায় ওঠেন এবং প্র্যাকটিস শুরু করেন। কিন্তু ডা. নন্দী তখন ষাটের কোঠায়। নতুনভাবে সব শুরু করার  মন আর তাঁর ছিল না।


EmoticonEmoticon