রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৮

মান্নার বড়ো কথা ও হাসিনার সম্ভাব্য ভাগ্য-বিড়ম্বনা

ঐক্যফ্রণ্টের কারিগর কামাল হোসেন নয়, কারিগর হচ্ছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। এটি অন্য কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, আমার বুঝতে এতোটুকু সমস্যা হয়নি, যদিও আমি বাংলাদেশ থেকে হাজার-হাজার মাইল দূরে আছি।

যাহোক, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন’-এর জপ-করা কামাল হোসেন যখন হঠাৎকরে শেখ হাসিনার কাছে সংলাপ চেয়ে পত্র লিখে ঐক্যফ্রণ্টের আন্দোলনের মধ্যে রূপতঃ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছেন, তখন মাহমুদুর রহমান মান্না যথেষ্ট ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত জরুরি কিছু “বড়ো বড়ো কথা” বলছেন, যার শেষটি হচ্ছে ‘মাইণ্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েইজ”, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে 'মুখ সামলে কথা বলুন'।

সত্যি বলতে, মাহমুদুর রহমান মান্নার রাজনৈতিক ডিগবাজীতে চ্যাম্পয়িনশিপের কারণে আমি তাঁর কঠোর সমালোচক হলেও, সম্প্রতি তাঁর ‘বড়ো কথাগুলো’ আমার কাছে প্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু আমি ভাবছিঃ সাংগঠনিকভাবে 'ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার' হওয়ার'পরও কীসের জোরে মাহমুদুর রহমান মান্না এ-কাজ করতে পারছেন?

আচরণ বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে আমার ধারণা, মাহমুদূর রহমান মান্নার প্রতি দুই পর্যায়ের ব্যাকিং আছে, যার একটি অন্তঃস্থ ও অন্যটি বহিঃস্থ। বাংলাদেশের যে-ডীপ ষ্টেইট বা গহীন-রাষ্ট্র আছে, তার কোনো একটি কিংবা একাধিক অংশ মাহমুদুর রহমানকে সাহস দিচ্ছে বলে আমার ধারণা। আর, বহিঃস্থ সাহসটা পাচ্ছে প্রতিবেশীর কাছ থেকে।

সন্দেহ নেই যে, শেখ হাসিনা মাহমুদূর রহমানকে মনে মনে চিবিয়ে খাচ্ছেন। সম্ভবতঃ তাঁর হাত নিশপিশ করছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না তিনি। তাঁকে মাহমুদুর রহমান মান্নার “ছোটোলোক” গালিও সহ্য করতে হচ্ছে এবং ইলেকশন কমিশনকে সহ্য করতে হয়েছে “মাইণ্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েইজ” ধমক।

আর মাহমুদুর রহমান মান্না জানেন, বাঙালী ইংরেজীতে ধমক দেওয়া মানুষকে সাংঘাতিক সম্মান করে। ঔপনিবেশিক শাসক ইংরেজরা প্রায় দু’শো বছর ইংরেজীতে শাসন করে যে-ভীতি মিশ্রিত শ্রদ্ধার জন্ম দিয়েছে, তা বাঙালীর রাজনৈতিক ও সামাজিক মননকে সাংঘাতিকভাবে ‘হিজোমোনাইজড’ করে রেখেছে।

যাক, জরুরি যে-বিষয়টি আমি বলতে চাই, তা হচ্ছেঃ শেখ হাসিনা সম্ভবতঃ ভারতের ব্যাকিং বা পৃষ্ঠপোষকতা ঠিক আগের মতো পাচ্ছেন না। শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে একজন ফ্যাশিষ্ট শাসক, কিন্তু তাঁর মতো সাহসী ও দক্ষ নারী রাজনীতিক এই উপমহাদেশেতো নয়ই, এমনকি বিশ্বেও এসেছে কিনা, তা চিন্তা করে বলার বিষয়।

ভারত সম্ভবতঃ শেখ হাসিনার 'ওভার কনফিডেন্স' ও চীন-ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করছে না। আর, শেখ হাসিনাও শেখ মুজিবুর রহমানের মতো প্রথম দিকে ভারত-নির্ভর হলেও শেষপর্যন্ত ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাচ্ছেন না। আমার এ-ধারণা সত্য হলে, একটি দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠেছে, যার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য, যেখানে শেখ হাসিনার ভাগ্য বিড়ম্বিত হওয়া হবে তার অন্তর্গত অংশ।

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শেখ হাসিনাকে ফ্যাশিষ্ট শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঐক্যফ্রণ্টের দাবী মেনে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হবে, কিন্তু তার অতিরিক্ত একটি কাজ করতে হবে তাঁকে। আর, সেটি হচ্ছে শাসনপদ্ধতির পরিবর্তনের জন্যে একটি রেফারেণ্ডাম বা গণভৌট অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনলে তার ক্রনিক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের জন্যে কী প্রকারের শাসন পদ্ধতির প্রয়োজন, সে-সম্পর্কে আমার ধারণাসমূহ আমি অচিরেই সবিস্তারে হাজির করবো। তবে, এখানে শুধু এতোটুকু বলবো যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যে নির্বাহী রাষ্ট্রপতি শাসিত রিপাবলিক হিসেবে জন্ম নিয়েছিলো, তাকে সেই নির্বাহী রাষ্ট্রপতি শাসিত রিপাবলিক হিসেবেই বিকশিত হতে হবে।

পরিশেষে, শেখ হাসিনা যদি মনে করেন যে, গায়ের জোরে ফ্যাশিষ্ট শাসন অনন্ত কাল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, তিনি অতি-অবশ্যই ভুল করবেন।


EmoticonEmoticon