রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৮

বাংলাদেশের জন্যে একটি শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব (১)

বাংলাদেশ রিপাবলিক যখন ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত এবং ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে বিশ্বের সামনে ঘোষিত হয়, তার পরিচালনা ও নেতৃত্বদানকারী সরকার ছিলো নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রাষ্ট্রপতিক সরকার। রাষ্ট্রপতি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পাকিস্তানে বন্দী থাকার কারণে তাঁর স্থলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অর্থাৎ, স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালীর যাত্রা শুরু হয় নির্বাহী রাষ্ট্রপতিক সরকারের পরিচালনায় তাদের জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

দুর্ভাগ্যবশতঃ ১৯৭২ সালে জনগণকে জড়িত করে পুঙ্খানুঙ্খ আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে সংবিধান রচনার পথে না গিয়ে, তা রচনায় নেতৃত্বের দায়িত্ব যখন দেওয়া হলেও মুক্তিযুদ্ধ না-করা আইনজ্ঞ কামাল হোসেন, তিনি প্রধানতঃ ভারতের সংবিধানকে আদর্শস্থানীয় গণ্য করে বাংলাদেশের জন্যে একটি সংবিধান রচনা করলেন, যেখানে আর নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপতির পদ থাকলো না। রাষ্ট্রপতিক সরকারের পরিবর্তে ভারতের মতো বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠিত হলো সংসদীয় সরকার।

পরবর্তী সময়ে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংসদের মাধ্যমেই সংসদীয় ব্যবস্থা বাতিল করে রাষ্ট্রপতিক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু অধিকতর দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি নিজের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ-সহ অনুগত কয়েকটি দলকে একত্রিত করে বাকশাল (বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) নামের একটি নতুন দল গঠন ও তাঁর বিরুদ্ধবাদী সকল দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতিক সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের আইন শাখা, প্রশাসন শাখা ও বিচার শাখার মধ্যে যে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি, তার কোনো বিধান রাখা হয়নি।

সর্বাধিক দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাকশালের গোপন-বিদ্রোহী নেতা খন্দকার মোস্তাক আহমেদের সম্পৃক্ততায় সামরিক বাহিনীর একটি অংশ ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাষ্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারে অধিকাংশ সদস্য-সহ হত্যা করলে বাকশালী শাসনের পতন ঘটলেও ভারসাম্যহীন রাষ্ট্রপতিক সরকার ব্যবস্থা জারি থাকে এবং তা ১৯৯১ সালের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত চলে।

১৯৯১ সালের ২রা জুলাই সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী প্রস্তাবিত হয়, যা একই বছরের ৬ই অগাষ্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, এবং ১৮ই সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে আইনে পরিণত হলে বাংলাদেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের পেছনে এই বিশ্বাস কাজ করে যে, রাষ্ট্রপতিক সরকার ব্যবস্থার চেয়ে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অধিকতর গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বশীল, যা অত্যাবশকীয়ভাবে সত্য ভিত্তিষ্ঠিত নয়।

বাংলাদেশের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইন তৈরি ও নির্বাহী ক্ষমতা আসে রাষ্ট্রের অভিন্ন অঙ্গ পার্লামেণ্ট বা আইনসভা থেকে। কারণ, পার্লামেণ্ট বা আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হন এবং তিনি নিজের ইচ্ছে অনুসারেই মন্ত্রী নিয়োগ করার মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেন প্রধানতঃ তাঁর দলীয় সাংসদদের নিয়ে। ফলে, তিনি নিজে প্রভূত পরিমাণ নির্বাহী ক্ষমতার ধারণ করে সেই ক্ষমতা প্রয়োগের প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো আইনসভায় তাঁর দলীয় সদস্যদের দিয়ে আইন তৈরি করিয়ে নেন।

প্রত্যক্ষভাবে আইন তৈরি ও  পরোক্ষভাবে নির্বাহী ক্ষমতা ধারণ করার কারণে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সংসদ হয়ে ওঠে একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেন এক স্বৈরশাসক। আর, এই ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ বাস্তবে পেশাদার রাজনীতিকদের দেশসেবার প্রতিষ্ঠান হওয়ার চেয়ে বিত্তবানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তাদেরকে এড়াতে পারেন না, কারণ তাদের সমর্থনের ওপরই তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকে থাকা নির্ভর করে।

বস্তুতঃ জাতীয় সংসদ একই সাথে আইন তৈরীর ও নির্বাহী ক্ষমতার ধারক হওয়ার কারণেই এই প্রতিষ্ঠানটি দখল করার জন্যে বাংলাদেশের বিত্তবান প্রবল শ্রেণীসমূহের প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে, আর এই প্রতিযোগিতার কারণেই রাষ্ট্রটিতে কখনও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় না।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন রাষ্ট্রের নির্বাহী-বিভাগ, আইনসভা ও বিচার-বিভাগ, এই দিন অঙ্গের মধ্যে পৃথকীকরণ করা এবং তাদের আপেক্ষিক স্বাধীনতা দিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে চলা।

আমি মনে করি রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্যে সর্বোত্তম পথ হচ্ছে – বাংলাদেশের জন্যে – সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নির্বাহী রাষ্ট্রপতিক সরকার ব্যবস্থার দিকে যাওয়া, দুই কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করা এবং বিচার-বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেওয়া। নীচে আমি আমার প্রস্তাবের প্রাথমিক রূপরেখা তুলে ধরছি। আমার উদ্দেশ্য হচ্চছেএকটি আলোচনার সূত্রপাত করে অন্যদের অবদান নিয়ে প্রস্তাবটি আরও সমৃদ্দধ করা।

রাষ্ট্র
বাংলাদেশ রিপাললিক হবে জনগণের রাষ্ট্র, যা ১৯৭১ সালে সৃষ্টিকালে প্রতিশ্রুত সাম্য, মানবিক মর্য্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, অঞ্চল ও জাতিসত্তা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করে চলবে।

রাষ্ট্রপতি
উপরে বর্ণীত রাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশে সমগ্র জনগণের প্রধিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের জন্যে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে তাদের সম্মতি অর্জনের জন্যে একটি প্রতিযোগিতামূলক স্বচ্ছ ও সৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সারা দেশের মোট ভৌটদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভৌটের ভিত্তিতে ন্যুনতম চল্লিশ বছর বয়স্ক যে-কোন স্বাভাবিক ও নিরপরাধ নাগরিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবেন।

রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত ব্যক্তি রাজনৈতিক দল ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবী আইনগতভাবে পরিত্যাগ করে প্রধান বিচারপতির কাছে সংবিধান রক্ষা ও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচানার শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর আইনসভার সদস্য ছাড়া যে-কোনো নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে আইনসভার উচ্চকক্ষের (নির্বাচিত নির্দলীয় জনপ্রতিনিধি) অনুমোদন ও প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ সাপেক্ষে সরকার গঠন করে তার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।

রাষ্ট্রপতি দায়বদ্ধ থাকবেন সংবিধান ও জনগণের কাছে, আর কারও কাছে নয়। তবে, তিনি যদি সংবিধান ও জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে আইনসভার নিম্নকক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যাবে, যা প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে আইনসভার উচ্চকক্ষে প্রকাশ্যে শুনানির ভিত্তিতে সেই সভার দুই-তৃতীয়াংশের ভৌটে তাঁকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত করা যাবে, এবং তার অপসারণের সাথে-সাথে তার প্রশাসন ও সরকারেরও অপসারণ ঘটবে। আর, পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ও অভিষিক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

আইনসভা
বাংলাদেশ রিপাবলিকের জন্মকালীন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনগণের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্য্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে আইনে শাসনের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার উদ্দেশ্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভৌটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইন তৈরির প্রতিষ্ঠান হবে জাতীয় সংসদ।

আইনকসভার নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংবিধানের আনুগত্যশীল যে-কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনীত কিংবা দল-নিরপেক্ষ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে, যাদের সংখ্যা নির্ধারিত হবে জনসংখ্যানুপাতে, তবে প্রতিটি জেলা থেকে অন্ততঃ একজন করে।

আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠিত হবে প্রতিটি উপজেলা থেকে সংবিধানের প্রতি আনুগত্যশীল একজন করে দল-নিরপেক্ষ নির্বাচিত ব্যক্তিকে নিয়ে, যাদের কোনো প্রকারের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি নেই।

যে-কোনো নতুন আইন সৃষ্টির প্রস্তাব বা প্রতিষ্ঠিত আইনের সংশোধন প্রস্তাব আইনসভার উভয় কক্ষের যে-কোনো সদস্যের মাধ্যমে আসতে পারে, কিন্তু তা আইন হিসেবে পরিণত হওয়ার জন্যে প্রথমে নিম্নকক্ষে গৃহীত হতে হবে, অতঃপর উচ্চকক্ষের ও সবশেষে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করতে হবে।

আইনসভার নিম্নকক্ষের যে-কোনো সদস্য রাষ্ট্রপতি বা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অপসাণের উদ্দেশ্য অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারবেন, কিন্তু তা সেই কক্ষের সমর্থন লাভ করার পর তা উচ্চকক্ষে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে এবং প্রধান বিচারপতি স্বয়ং অভিযুক্ত হলে রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে শুনানির পর সেখানে দুই-তৃতীয়াংশের ভৌটে অনুমোদিত হতে হবে।

আইনসভার যে-কোনো সদস্যকে তাদের নির্বাচকমণ্ডলী যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব না করার অভিযোগে প্রত্যাহার (Recall) করার অনুরোধ জানিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন এই অভিযোগ বিবেচনাযোগ্য হিসেবে গণ্য করলে আত্মপক্ষ সমর্থন-সহ শুনানির মধ্য দিয়ে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাতিল করে অভিযুক্ত সাংসদের পদ প্রত্যাহার বা বহাল রাখতে পারবেন। (চলবে)


EmoticonEmoticon