রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৮

রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে

আমি কিছু বিষয় মৌলিক আঙ্গিকে আনতে চাই, যার জন্যে রাষ্ট্র কী, তা বুঝা জরুরি। তো, রাষ্টের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নতুন করে চাকা আবিষ্কারের শ্রম না করে এ-সংক্রান্ত বিতর্ক সঞ্জাত আমার একটি লেখা পুনঃপ্রকাশ করছিঃ

"অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের সাথে লড়তে যে-রণকৌশল অবলম্বন করেছেন সেটি শোভন নয়। ফরহাদ মজহারকে নির্বোধ প্রমাণ করতে গিয়ে সলিমুল্লাহ খান লিখেছেনঃ

“রাষ্ট্র বলিতে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ ‘জনগোষ্ঠী’– বা আজকালকার ভাষায় ‘জাতি’– বুঝায়। নিঃসন্দেহে এই পাণ্ডিত্য বুঝার ক্ষমতা তাঁহার আছে। আর যদি না থাকে তবে তিনি ক্ষমার যোগ্য। কেননা অবুঝ লোকের কোন অপরাধ নাই।”

উপরের কথাগুলো সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন গত ৫ নভেম্বরে বিডিনিউজ২৪.কম নামের একটি ইণ্টারনেট-পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ফরহাদ মজহারের বোমা বা রেটরিক প্রসঙ্গে’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে।

সলিমুল্লাহ খান স্পষ্টতঃ এখানে জ্ঞানদান করেছেন; সেই জ্ঞানকে “এই পাণ্ডিত্য” হিসেবে দাবী করেছেন; “এই পাণ্ডিত্য” বুঝতে না-পারাকে নির্বুদ্ধিতা হিসেবে নির্দেশ করেছেন; এবং “যদি”-“তবে”র শর্তাধীনে ফরহাদ মজহারের সম্ভাব্য নির্বুদ্ধিতা জনিত “অপরাধ”-এর প্রতি “ক্ষমা” প্রদর্শন করে তিনি তাঁকে অপমান করেছেন।

কিন্তু সলিমুল্লাহ খান হয়তো লক্ষ্য করেননি যে, তাঁর এই রণকৌশল তাঁকেও ভাল্‌নারেবল বা অরক্ষিত করে ফেলেছে। সম্ভবতঃ অতিশয় আত্মবিশ্বাস-জাত অহংকারের কারণে তিনি নিজের সুরক্ষার কথা ভাবেননি। আমার এ-লেখায় আমি এটিই দেখাতে চাইবো যে, সলিমুল্লাহ খানও ‘অবুঝ’ প্রতিপন্ন হতে পারেন। আর এটি আমি দেখাবো ঠিক সেখানেই, যেখানে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ফরহাদ মহজারকে দেখিয়েছেন।

আমি প্রথমেই অপর্যাপ্ত প্রমাণ করবো রাষ্ট্র বিষয়ে সলিমুল্লাহ খানের দেওয়া সংজ্ঞা তথা তাঁর দাবীকৃত “এই পাণ্ডিত্য”কে।

সলিমুল্লাহ খানের ভাষায় “রাষ্ট্র বলতে” যদি “রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠী”ই বুঝাবে, তাহলে দীর্ঘকাল যাবৎ রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ থাকার পরও প্যালেষ্টাইনীরা একটি রাষ্ট্র হলো না কেনো?  সলিমুল্লাহ খানের সংজ্ঞানুসারে তো প্যালেষ্টাইনী জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র হওয়ার কথা, কিন্তু হয়নি। এমনকি এরা জাতি হিসেবে জাতিসংঘের সদস্যত্ব পাওয়ার পরও রাষ্ট্র নয়।

পৃথিবীতে রাজনৈতিকভাবে সঙ্ঘবদ্ধ এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে, যারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে যুগ-যুগ ধরে সংগ্রাম করছে, কিন্তু পারছে না। তিব্বতী, চেচেনীয়, কুর্দী, কাশ্মিরী, ইত্যাদি বহু জনগোষ্ঠীর উদাহরণ দেওয়া যায়।  এমনকি সলিমুল্লাহ খানের নিজের জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের দিকে তাকালেও একই দেখা যায় যে, শুধু সংঘবদ্ধ হলেই রাষ্ট্র হওয়া যায় না।

পূর্ব বাংলার বাঙালী জনগোষ্ঠী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রণ্টের নির্বাচন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যূত্থান এবং ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিলো। সে-সময়ে বাঙালী জাতির অবস্থান কি বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলো? না, হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যে পাকিস্তানের বাঙালী জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধ করতে হয়েছিলো।

তো, আমরা ইতিহাস ও ভূগোল ঘেঁটে দেখতে পাচ্ছি যে, একটি জনগোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হলেই রাষ্ট্র হয়ে যায় না। কারণ, রাষ্ট্র মানে সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠী, সলিমুল্লাহ খানের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

স্পষ্টতঃ সলিমুল্লাহ খানের সংজ্ঞা রাষ্ট্রকে ধারণ করে না। তাঁর সংজ্ঞা দিয়ে রাষ্ট্রের স্বরূপ বুঝা যায় না। কারণ, রাষ্ট্র কাকে বলে তা উপলদ্ধি করার ক্ষেত্রে সলিমুল্লাহ খান দৃশ্যতঃ এখনও “অবুঝ” রয়েছেন (আমি দুঃখিত তাঁর ব্যবহৃত শব্দটি তাঁর ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে হলো বলে, তাই উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখিছে শব্দটি আমার নিজের নয় বুঝাবার জন্য)।

সলিমুল্লাহ খান সম্ভবতঃ অক্সফৌর্ড ডিকশনারিতে দেওয়া রাষ্ট্রের সংজ্ঞাটির বঙ্গীয় পুনরুৎপাদন করে থাকবেন। অক্সফৌর্ড ডিকশনারিতে স্টেইট বা রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বলা হয়েছেঃ

“এ্যা নেশন অর টেরিটোরি কনসিডার্ড এ্যাজ এ্যান অর্গানাইজড পলিটিক্যাল কমিউনিটি আণ্ডার ওয়ান গভর্ণমেণ্ট (A nation or territory considered as an organized political community under one government)”। অর্থাৎ, রাষ্ট্র হচ্ছে “একটি জাতি বা ভূখণ্ড যা এক সরকারের অধীনে একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচিত।”

দৃশ্যতঃ সলিমুল্লাহ খানের সংজ্ঞা অক্সফৌর্ড ডিকশানারির সংজ্ঞার চেয়েও অসম্পূর্ণ এবং ভাষাগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। আর তাকেই তিনি “এই পাণ্ডিত্য” বলে নির্দেশ এবং তার সম্ভাব্য অগ্রহণীয়তাকে “অবুঝ” অবস্থা বলে ক্ষমা প্রদর্শন করছেন।

কিন্তু হায়, যদি পণ্ডিতবর সলিমুল্লাহ খান বুঝতেন যে, রাষ্ট্র বিষয়ে ডিকশনারির সংজ্ঞাকে কেউ পাণ্ডিত্য বলে না! পাণ্ডিত্য তার চেয়েও অধিক কিছু, যা দর্পিত চোখে ডিকশনারিতে খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রথমতঃ সলিমুল্লাহ খানের বুঝা উচিত যে, রাষ্ট্র ও জনগোষ্ঠী এক নয়, তা রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ কিংবা অসংঘবদ্ধই হোক না কেনো। জনগোষ্ঠী প্রাণীপাল কিন্তু রাষ্ট্র অপ্রাণী; রাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র কৃত্রিম কিন্তু জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক। জনগোষ্ঠী প্রাচীন, আর রাষ্ট্র নবীন। আপেক্ষিক বিচারে রাষ্ট্র সাময়িক, কিন্তু জনগোষ্ঠী স্থায়ী।

দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্রকে জাতির সমার্থক মনে করা হলেও রাষ্ট্র আর জাতি এক নয়। পৃথিবীতে বহু জাতি আছে যারা রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত নয়। আর বহু রাষ্ট্র আছে যেখানে বহুজাতি একত্রে অবস্থান করে। রাষ্ট্র ও জাতি অভিন্ন নয় বলেই সাম্রাজ্যের বিপরীতে জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে নেশন স্টেইট বা জাতিরাষ্ট্র বলা হয়। যেমন বাংলাদেশ একটি নেশন স্টেইট।

তৃতীয়তঃ রাষ্ট্র এমনকি দেশও নয়। বাংলাদেশে এখন যে-রাষ্ট্র আছে, সেটি ১৯৭১ সাল থেকে বর্তমান। তার আগে এখানে ছিলো প্রায়-ঔপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্র। তার আগে ছিলো ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-ভারত রাষ্ট্র, তার আগে ছিলো মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সুবে-বাংলার সামন্ত রাষ্ট্র। এভাবে অনেক পেছনে যাওয়া সম্ভব। পেছনে যেতে থাকলে দেখা যাবে এক সময় এখানে কোনো রাষ্ট্রই ছিলো না। কিন্তু তখনও এখানে জনগোষ্ঠী ছিলো। মানুষ রাজনৈতিক জীব বলে সংজ্ঞানুসারে তারা রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধই ছিলো, কিন্তু রাষ্ট্র ছিলো না।

দৈনিন্দন ভাষায় দেশ ও রাষ্ট্র অভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও, বাস্তবে এ-দুটো এক নয়। তাই দেশের নাম ও রাষ্ট্রের নাম ভিন্ন। রাশিয়ায় এখন যে রাষ্ট্র আছে, তার নাম রাশান ফেডারেশন। তার আগের নাম ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেখানে আরও দেশ ছিলো। এখনও অনেক দেশ আছে। কিন্তু রাশিয়া বলতে যে দেশ বুঝায় সেটি রাশিয়া নামে আছে।

এক রাষ্ট্রে একাধিক দেশ থাকতে পারে, যেমন ইউনাইটেড কিংডম (ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড, ওয়েলস ও নর্দার্ন অ্যায়ারল্যাণ্ড, যারা আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় নিজ-নিজ দেশের ফুটবল টীম নিয়ে অংশগ্রহণ করে)। আবার একই দেশ একাধিক রাষ্ট্রের অধিকারে যেতে পারে, যেমন প্রকৃত বাংলাদেশ বা বেঙ্গল বর্তমানে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ও ‘ভারত গণরাজ্য’ নামে দু’টো ভিন্ন-ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্গত।

চতুর্থতঃ রাষ্ট্র সরকারও নয়। সরকার হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পরিচালক। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রশাসন ছাড়াও আছে আইনসভা ও বিচার বিভাগ। প্রকৃত গণতন্ত্রে এগুলো পৃথক সত্তা হিসেবে পরস্পরের সাথে ‘চেক-এ্যাণ্ড-ব্যালেন্স’ করে অবস্থান করে। গণতন্ত্রে সরকার কয়েক বছর পর-পরই পরিবর্তিত হয়, আবার স্বৈরতন্ত্রে হয়তো আরও কিছুকাল বেশি আয়ুষ্মান হয়। কিন্তু রাষ্ট্র সংজ্ঞানুসারে নিজেকে চিরঞ্জীব দাবী করে, যদিও বাস্তবে তা হয় না।

সলিমুল্লাহ খান যে রাষ্ট্রের এসেন্স বা সত্তা বুঝতে পারেননি, তা আর স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার রাষ্ট্রদ্রোহিতার সংজ্ঞা লক্ষ্য করলে। একই প্রবন্ধে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার একটি সেমি-ডেফিনিশন বা পাতিসংজ্ঞা দিয়েছেন উদাহরণ সহঃ

“ফরহাদ মজহার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে পটকা (বা ককটেল) মারা পর্যাপ্ত নহে মনে করেন। গণমাধ্যমে হামলা পরিচালনা পাবলিক অর্ডার বা রাষ্ট্রীয় শান্তিভঙ্গের শামিল। ইহার অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহিতা বটে।”

“গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে পটকা মারা পর্যাপ্ত নহে” মনে করাকে “রাষ্ট্রদ্রোহিতা বটে” বলার মধ্য দিয়ে সলিমুল্লাহ খান প্রমাণ করলেন যে, তিনি রাষ্ট্রের এসেন্স বা মূলসত্তা যে তার সার্বভৌম ক্ষমতা, তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাঁর বুঝা উচিত যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ট্রীজন বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয় না। 

পাবলিক অর্ডার বা গণশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দাঙ্গা করলে তা রায়ট হতে পারে, কিন্তু ট্রীজন হয় না। আবার, পাবলিক অর্ডার বা গণশৃঙ্খলা ভঙ্গ কিংবা দাঙ্গা-ফ্যাসাদ না করেও যদি নীরবে নিভৃতেও রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলা হয়, তাহলেও তা ট্রীজন বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতে পারে।

পৃথিবীর দেশে-দেশে আইনের ভিন্নতা থাকলেও রাষ্ট্র সংক্রান্ত মৌলিক ধারণাগুলো মোটামুটি একই রকম। বাংলাদেশের আইনের ভিত্তি প্রধানতঃ ব্রিটিশ আইন। তাই আমি বিষয়টি বুঝানোর জন্য দুই দেশকে জড়িত করে উদাহরণ দিচ্ছি আমার জানা ঘটনা থেকে।

বাঙালী জাতির আধুনিক ইতিহাসে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিখ্যাত বা কুখ্যাত মামলাটি হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশে তথা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলে পরিচিত। তাতে কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে পাবলিক অর্ডার ভঙ্গের অভিযোগ করা হয়নি। পাবলিক অর্ডার ভঙ্গ করার অভিযোগে তিনি ইতিপূর্বে একাধিকবার গ্রেফতারিত হয়েছিলেন কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হননি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান-সহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখণ্ডতা তথা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ১৯৬৭ সালে গোপন সভা অনুষ্ঠিত করার দায়ে। ঘটনাটি তখন মিথ্যা বলে জানলেও এখন আমরা সত্য বলে জানি ঐ মামলারই অন্যতম আসামী ক্যাপ্টেন শওকত আলীর সাম্প্রতিক স্বীকারোক্তিতে।

বিপরীতে, ইংল্যাণ্ডে ২০১১ সালের গ্রীষ্মেকালে রাজধানী লণ্ডন ও অন্যান্য শহরে যে পাবলিক অর্ডারের চরম লঙ্ঘন করে ৬ থেকে ১০ অগাষ্ট পর্যন্ত ভয়ঙ্কর দাঙ্গা বা রায়ট হয় - যা ইংলিশ রায়ট হিসেবে কুখ্যাত - সেখানে তিন হাজারের বেশি দাঙ্গাকারীকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১০০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয়। কিন্তু এই চার্জগুলোর মধ্যে একটিও রাষ্ট্রদ্রোহিতার চার্জ ছিলো না।

আমার মনে হয়, আমি সলিমুল্লাহ খানের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিষয়ক সংজ্ঞা দু’টোর সৎকার করতে পরেছি। কিন্তু আমার পাঠকরা হয়তো ভাববেনঃ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা তা হলে কী? স্থান অফুরন্ত নয় বলে আমি পাঠ্যপুস্তকী সংজ্ঞার পুনরুৎপাদনে যাচ্ছি না। কার্ল মার্ক্স, এমিল ডারকাইম কিংবা বহুল উদ্ধৃত ম্যাক্স ওয়েবারে যাচ্ছি না। তবে একটি ওয়ার্কিং ডেফিনিশন বা কার্যকরী সংজ্ঞা গণসম্পত্তি হিসেবে দিচ্ছি, যাকে আরও বিকশিত করা সম্ভব। কারণ, রাষ্ট্রের ইতিহাসের মতো রাষ্ট্রের সংজ্ঞারও একটি ইতিহাস রয়েছে।

আমার মতে, রাষ্ট্র হচ্ছে নির্দিষ্ট সীমানার স্থল-জল-অন্তরীক্ষ অধিকারী এমন একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান, যা তার অন্তর্গত অন্যান্য যথাযথ প্রতিষ্ঠান দ্বারা ঐ সীমানার অন্তর্গত সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিধি তৈরির এবং বলপ্রয়োগে তা কার্যকর করার স্বীকৃত ক্ষমতা রাখে।

উপরের সংজ্ঞার মধ্যে আমি মানুষের কথা উল্লেখ করিনি, কারণ মানুষ রাষ্ট্রের সম্পদ বলে মনুষ্য প্রকরণ ‘সমস্ত কিছু’ মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। এখানে আমি ভূখণ্ড না বলে স্থল-জল-অন্তরীক্ষ বলেছি, কারণ রাষ্ট্রের সমূদ্র ও আকাশ সীমাও আছে। ভবিষ্যতে হয়তো বিশ্ব ছাড়িয়ে মহাশূন্যেও বিস্তৃত হতে পারে। আমি অন্তর্গত ও যথাযথ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিধি প্রণয়ন ও বলপ্রয়োগে কার্যকর করার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রের প্রশাসন-আইনী-বিচার-প্রতিরক্ষা ও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করেছি। আমি শুধু সার্বভৌমত্বের কথা নয়, স্বীকৃত সার্বভৌমত্বের কথা বলেছি, কারণ সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের মূলসত্তা হলেও বিশ্বসভায় তার স্বীকৃতিরও প্রয়োজন হয়।

তবুও আমি জানি, আমার এ-সংজ্ঞা পরিপূর্ণ নয়। কিন্তু আপাততঃ কাজ চলবে বলে মনে হয়। এ-সংজ্ঞা সবার কাছে বোধগম্য বা গ্রহণীয় নাও হতে পারে। না হলে নিজেকে ‘অবুঝ’ ভাবার কোনো কারণ নেই এবং না-বুঝাটা অপরাধ নয়।"

[উপরের  লেখাটি পাঁচ বছর আগে, ২০১৩ সালের ২২শ নভেম্বরে, ukbengali.com-তে প্রকাশিত হয়]


EmoticonEmoticon