নিপীড়িত জাতির জাতীয়তাবাদ একটি লড়াইয়ের অংশ। কিন্তু খেলার জন্য অতি জাতীয়তাবাদী আচরণ বাস্তবে ভাল কিছু বয়ে আনে না। ক্রিকেট পাগল বাঙালী বাংলাদেশ টিমের খেলায় এমন অংহকারী হয়ে উঠে যে নিজেদের দুর্বলতাগুলো ভুলে যায়।
পাকিস্তানের সাথে বাঙালিদের মনতাত্ত্বিক বিরোধ ঐতিহাসিক। এই বিরোধ সহজে মীমাংসা হওয়ার নয়। পাকিস্তানের ১৯৭১ সালের গণহত্যার দায় আমরা পাকিস্তানি জনগণের উপর চাপাইয়া দিতে পারি না। কেন পারি না? তার একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হাজির করবো। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা। ফলে পাকিস্তান গঠনের দায় বঙ্গের মানুষের আছে, বড় বড় নেতাদের আছে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতো তবে কী তা ভাঙ্গার দরকার ছিল? পাকিস্তান শুরুতেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে শুরুতেই সে তার বিভিন্ন প্রদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছিল। ত্রুটি বিচ্যুতি সহ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের একটি সংবিধান রচিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিবিদের ব্যর্থতার কারণে চলে আসে সামরিক একনায়কতন্ত্র। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাকিস্তানের পূর্ব অংশের সাথে পশ্চিম অংশের বৈষম্য আরো প্রকট হতে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অন্য অংশের সাথে পূর্ববঙ্গের জনগণের কোন সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে নাই। ফলে মনতাত্ত্বিক বিরোধ, ঘৃণা তখনো ছিল। পূর্ব বাংলার মুসলমানকে পাকিস্তানি মুসলমানরা খাটি মুসলমান মনে করতো না। কিন্তু নানা তথ্যে দেখা যায় পূর্ব বাংলার মুসমানরা ধর্মভিরু ছিল পাকিস্তানের মুসলমানের চেয়ে।
সামরিক শাসন, দুর্নীতি, অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাকিস্তানের বিকাশে বাধাগ্রস্থ করেছিল। স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ দেখা দিলে আইয়ুব খান গোপনে ক্ষমতা ইয়াহিয়ার কাছে দিয়ে চলে যায়। ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসে নির্বাচন দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে ক্ষমতা নিজের অধীনে রাখার গোপন লিপ্সা ছিল। ফলে ৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে টালবাহানা করে। আবার একজন বাঙ্গালী আঞ্চলিক নেতার হাতে সমস্ত পাকিস্তানের ক্ষমতা দেওয়ার ইচ্ছা পাকিস্তানের মিলিটারী নেতাদের ছিল না। ফলে গণহত্যার এই ছক নির্মিত হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবনে। মূল আয়োজক মিলিটারী ক্ষমতাশীলরা। সাথে ছিল ক্ষমতা লিপ্সু ভুট্টোর মত রাজনীতিবিদরা। পাকিস্তান আওয়ামীলীগ, ন্যাপ সহ অনেক দল কিন্তু শেখ মুজিবের অধীনে শাসন মেনে নিয়েছিল। কারা নেয় নাই? ইয়াহিয়ার অধীনে সামরিক শাসকরা। আর ২য় অবস্থানে থাকা ভূট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি। সেই মিলিটারী শাসকদের কারণে পূর্ব বাংলায় গণহত্যার আয়োজন হয়েছিল। যা পাকিস্তানের অনেক সাধারণ জনগণ জানতো না, রাষ্ট্রের শাসকরা কী করছে না করছে। ফলে একজন সাধারণ নাগরিক, একজন কৃষক, একজন সীমান্তের কাছে বসবাস করা পাহাড়ি আদিবাসী কী গণহত্যায় দায়ী ছিল? হ্যাঁ পাকিস্তানে সেভাবে প্রতিবাদ হয় নাই এর বিরুদ্ধে। এর কারণ ছিল জনগণের সচেতনতা সেই মাত্রায় ছিল না, অন্যদিকে সরকার প্রচার করেছিল কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী দেশ ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সরকার সামরিক একশন নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও তাদের জেলে যেতে হয়েছে। ফলে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের একটি গণহত্যার দায় কী সমস্ত জনগণের? তখন পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ছয় থেকে সাত কোটি এবং সেখানে বিভিন্ন জাতির বাস। এজন্য পাকিস্তান মানে ইয়াহিয়া ভূট্টো রাও ফরমান আলী নিয়াজি নয়। পাকিস্তান হল ধর্মীয় কসংস্কারে জর্জরিত একটি রাষ্ট্র যেখানে সাধারণ মানুষকে একটি অন্ধকারের মধ্যে রেখে শাসক শোষক শ্রেণী প্রতিনিয়ত শোষণ নিপীড়ন করে চলেছে। পাকিস্তানের বেলুচরা এখনো স্বাধীনতার লড়াই করছে। পাকিস্তানের শ্রমিক কৃষক সাধারণ নিপীড়িত জনগণের প্রতি আমরা ঘৃণা প্রকাশ করতে পারি না। কারণ সে আমার মতই শোষিত বঞ্চিত। হ্যাঁ ঘৃণা অবশ্যই রাখতে হবে পাকিস্থানের তখনকার শাসক এবং সামরিক বাহিনীর লোকজনের প্রতি যারা এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আজকের পাকিস্তানের জনগণকে সেই গণহত্যার জন্য কতটুকু দায়ী করতে পারি? হ্যাঁ অবশ্যই পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুই দেশের শাসক পর্যায়ে যে বৈরি সম্পর্ক তা হওয়ার বাস্তবতা দেখি না। নিপীড়িত জাতির ঘৃণা একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থাকবে। তবে এই ঘৃণার চর্চা করা উচিত নয়।
EmoticonEmoticon