সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

যতীন্দ্রমোহন বাগচী

কাজলা দিদি
- যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক্-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে,
থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই,
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন
দিদি বলে ডাকি তখন,
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি, তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল্ মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে
আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন ক'রে রবে?
আমিও নাই---দিদিও নাই---কেমন মজা হবে!
ভূঁই-চাঁপাতে ভরে গেছে শিউলী গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল |
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বুলবুলিটা লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা ছিঁড়তে গিয়ে ফল,
দিদি যখন শুনবে এসে বলবি কি মা বল |
বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর তলে পুকুর পাড়ে
ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতো জেগে রই,---
রাত্রি হলো মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?
আজও শৈশবের গন্ধ লেগে আছে এই কবিতায়।কাজলা দিদিকে চিরকাল আমার নিজের দিদি ভেবে বেড়ে উঠেছি,আজও আছে।এই কবিতার এমনই প্রভাব!
এই কবিতাটিতে কোনো পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ নেই, তত্ত্ব বা ভাষার আতিশয্যও নেই। কিন্তু অত্যন্ত সহজভাষায় লেখা এই কবিতাটি যে কোনো হৃদয় নাড়া দেয়। কাজলা দিদির শোকে কাতর ভাইটি যে প্রত্যেক পাঠকের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ।কবিতাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের শৈশবস্মৃতি। আমরা সবাই কম-বেশি এই কবিতাটি পড়েছি। সে কবিতাটি সব কালের পাঠকদেরই কাঁদায়। কাজলা দিদি সকলের দিদি হয়ে যায় শৈশবে ।
এ জায়গাতেই তিনি অনন্য কবি ও সাংবাদিক যতীন্দ্রমোহন বাগচী।দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই কবিতাটি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন: ‘কবিতাটি সোনার অক্ষরে ছাপানো উচিৎ ছিল।’
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুতে  নিজের মনকে শান্তনা দিতে তেরো বছরের এক কিশোর লিখে ফেলল বিদ্যাসাগর স্মরণে ছোট্ট একটা কবিতা। এ কবিতা শুনে অনেকেই বিস্মিত হয়ে যায়। অনেকের চোখ জলে ভরে ওঠে। এতটুকু ছেলে কি এক শোকের বাণী রচনা করে ফেলল।
‘পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চল্ না ঠাকুরঝি
ওমা এ যে ঝরা বকুল। নয়?’
গা শিউরে ওঠে অনুভবে। কোনো চক্ষুস্মানের এভাবে কোনো অন্ধ নারীর বেদনা অনুভব করতে পারা এবং তার বর্ণনায় পাঠকের হৃদয় নাড়া দিতে পারা মোটেই সহজ নয়।  এই কাব্যগ্রন্থেই সেই বিখ্যাত ‘দিদিহারা’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত ছিল:বইটি উৎসর্গ করেছিলেন কবিগুরুর নামে ।
যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৮৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জমশেরপুরের বিখ্যাত বাগচী জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস হুগলি জেলার বলাগড় গ্রামে। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী। বাবা হরিমোহন বাগচী এবং মা গিরিশমোহিনী দেবী। বাগচী পরিবার ছিল তখনকার একটি মুক্তচিন্তার পাঠশালা। এ পরিবারের রামপ্রাণ বাগচী, জ্ঞানেন্দনারায়ণ বাগচী ও কবি দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী তখন সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত নাম।
ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের শক্তিমান কবিদের অন্যতম। পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্য ও পল্লী জীবনের সুখ-দুঃখের কথা তিনি দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করেন। পল্লী-প্রীতি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিমানসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘পথের পাঁচালী’র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবি জীবনানন্দ দাশের মত তাঁর কাব্যবস্তু নিসর্গ-সৌন্দর্যে চিত্ররূপময়। গ্রাম বাঙলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন। গ্রাম জীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ সরল ভাষায় সহৃদয়তার সংগে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত ও নিপীড়িত নারীদের কথা তিনি বিশেষ দরদের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। ‘কাজলাদিদি’ ও ‘অন্ধবন্ধু’ তাঁর এ ধরনের দুটি বিখ্যাত কবিতা।
ছাত্রাবস্থা থেকেই ঠাকুর বাড়ির বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা ‘ভারতী’ এবং সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় যতীন্দ্রমোহনের প্রথম যুগের কবিতা একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকলে তিনি কবি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
তিনি কলকাতার ডাফ কলেজ (এখন স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে ১৯০২ সালে বিএ পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে নদীয়াস্থ জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এসবে তার মন বসল না। তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানে তিনি পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তার শৈশব জীবনের লেখা তখনকার আলো ও উৎসাহ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিচারপতি সারদাচরণ মিত্রের সচিব, নাটোরের মহারাজার সচিব, কলকাতা কর্পোরেশনের লাইসেন্স-ইন্সপেক্টর, এফ.এন গুপ্ত কোম্পানির ম্যানেজার প্রভৃতি পদে চাকরি করেন।
কবির জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ।


EmoticonEmoticon