সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

শহীদ বুদ্ধিজীবি মুনীর চৌধুরী

‘মুনীর চৌধুরী আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একটি অবিস্মরণীয় প্রতিভা। আমাদের দেশে আধুনিক নাটকের তিনিই জনক। ‘রাজার জন্মদিনে’ নাটিকায় মুনীর চৌধুরীর যে নাট্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটেছিল, তা সার্থকতার সোপান বেয়ে বিকাশের এক পরিণত স্তরে পৌঁছেছিল ওথেলোতে। তাঁর এই উত্তরণের সাথে সাথে আমাদের নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করেছে।
বাঙালি সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধাশীল মুনীর চৌধুরী সংস্কৃতির ওপর কোনো আঘাতকে সহ্য করেননি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিলে তিনি তার প্রতিবাদ জানান। পরের বছর সংস্কারের নামে বাংলা বর্ণমালা বিলোপের উদ্যোগ নেওয়া হলে তিনি তারও প্রতিবাদ করেন। মুনীর চৌধুরী সমকালীন জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গেও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তার সঙ্গে একাÍতা ঘোষণা করে তিনি পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৬) খেতাব বর্জন করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। ছেলের জন্যে গরম ভাত বেড়ে বসে আছেন মা। ধোঁয়া উড়ছে গরম ভাত থেকে। চুল না আঁচড়িয়েই খেতে বসতে যাবেন তিনি। এমন সময়ে কালো কাপরে মুখ ঢাকা কিছু লোক এসে উঠিয়ে নিয়ে গেলো উনাকে। পেছনে রেখে গেলেন মায়ের বাড়া গরম ভাত, মা, ভাইবোন, বিশ্ববিদ্যালয়, সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, স্ত্রী আর প্রিয় উত্তরাধিকার। আর ফিরে এলেন না তিনি। খুঁজেও পাওয়া যায়নি মুনীর চৌধুরীকে আর কোনোদিন।
মুনীর চৌধুরীকে যখন মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের নির্যাতন কেন্দ্রে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তার পরনে ছিলো লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। সেখানে উর্দু ভাষায় নয়, বাংলা ভাষায়ই তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনি কি কিছু লিখেছেন?'
'হ্যাঁ, লিখেছি'।
একথা জিজ্ঞেস করা হয় মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকেও। তিনিও সম্মতি জানান।
সাথে সাথেই ঘাতকদের লোহার রড নেমে আসে তাঁদের শরীরে, চলে দীর্ঘক্ষণ অকথ্য নির্যাতন। নির্যাতনের তীব্রতায়ও এঁরা কেবল আর্তনাদ করেছেন, দয়াভিক্ষা চাননি।
একথা বলেছেন মোহাম্মদপুরের ওই নির্যাতনকেন্দ্র থেকে প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন। মূলত তাঁর দেয়া সাক্ষ্যই ছিলো আলবদর কমাণ্ডার মুজাহিদের কৃতকর্মের প্রধান প্রমাণ। দেলোয়ার হোসেন আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন শাস্তি এড়িয়ে চৌধুরী মঈনুদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খান লণ্ডনে পালিয়ে গেছে, হয়তো চিরকালের জন্যই।
মুনীর চৌধুরী পুরো পাকিস্তানপর্বেই শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিলেন, একাধিকবার তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছে, কিন্তু  নির্যাতনের পূর্বমূহুর্তে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু লিখেছেন কি না। এটি ঠিক স্বীকারোক্তি আদায় নয়, ঘাতকের দল ভালো করেই জানতো মুনীর চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করেছেন, নিবন্ধ লিখেছেন; তাঁকে নির্যাতনের ও হত্যার পরিকল্পনা তাঁদের আগেই ছিলো, এই প্রশ্নটি, এখানে, মুনীর চৌধুরীকে করা হয়েছে কেবল আক্রোশ মেটানোর জন্য।  রবীন্দ্রসংশ্লিষ্টতাও পাকিস্তানের দালালদের কাছে শত্রুতা বলে বিবেচিত হবে- এ আর আশ্চর্য কি?
দেশভাগের পর পূর্বপাকিস্তানের সাহিত্যজগতের সবচেয়ে আলোচিত, উজ্জ্বল নাম ছিলেন এই মুনীর চৌধুরী। বিদ্যানুরাগী মুনীর চৌধুরী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অতুলনীয়, তাঁর বাগভঙ্গী ছিলো ঈর্ষণীয় এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই। জেলে বসেই লিখেছিলেন 'কবর' নাটক। জেলখানাতেই এর প্রথম মঞ্চায়ন। 'নাট্যগতপ্রাণ' মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটকে গুলিবিদ্ধ লাশেরা যখন বলে ওঠে- 'আমরা কবরে যাব না, আমরা বাঁচবো'- সেটি কি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বলিষ্ঠতার ইঙ্গিতবাহী নয়?
বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশায় মুনীর চৌধুরীর নামটি প্রথম সারিতে থাকার আরও নানা কারণ রয়েছে। পাকিস্তান সরকারের দেয়া 'সিতারা-ই-ইমতিয়াজ' খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মুনীর চৌধুরী, পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে প্রতিবাদপত্রে যে নামটি সবার আগে ছিলো- সেটি মুনীর চৌধুরীর। এসব 'ঔদ্ধত্য' স্বভাবতই পাকিস্তানীদের সহ্য হয়নি। বলা ভালো- পাকিস্তানী ভাবাদর্শে দীক্ষিত এদেশীয় দালালদের সহ্য হয়নি।
তারা ভালোই জানতো- একজন মুনীর চৌধুরীর বেঁচে থাকা স্বাধীন বাংলাদেশকেও ঋদ্ধ করবে নিশ্চিত, তাই যুদ্ধে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে মুনীর চৌধুরীকে বেঁচে থাকতে দেয়া চলে না। পরাজিতরা, বলা ভালো, অক্ষম পরাজিতরা এভাবেই প্রতিশোধ নেয়।
স্বাধীনতার পর অনেকে জানতে চেয়েছে- 'মুনীর চৌধুরীকে ওরা মারলো কেন?' অধ্যাপক আনিসুজ্জামান উত্তরে বলেছিলেন- 'আপনাদের চেয়ে ওরা তাকে ভালো চিনেছিলো বলে'।
ঠিক এই ভাবধারার মানুষ কি নেই? এই বাংলাদেশীদের ভেতরই? রবীন্দ্রনাথ তাদের কাছে শত্রু, রবীন্দ্রনাথ প্রগতিবাদী। আর সকল প্রগতিবাদিতার শত্রু এই পাকিস্তানী চেতনা। মুনীর চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখলে তাঁকে শত্রু বিবেচনা করা ছাড়া তাদের উপায় নেই।
পাকিস্তানী ভাবধারার মানুষ, বাংলাদেশের শত্রু এখনও আছে, এদেশেই আছে, বিপুল পরিমাণেই আছে।
জন্মদিনেও চোখ ভিজে আসে তোমার জন্য , এতদিন পর নিশ্চয় তুমি ঘুমুতে পারছ। তোমাকে , তোমার চেতনাকে যে জানোয়াররা ধ্বংস করতে চেয়েছিল সেইসব ঘাতকদের নিশ্চিহ্ন আজ সময়ের ব্যাপার ।
শহীদ বুদ্ধিজীবি নাট্যকার মুনীর চৌধুরী -আজন্ম নত মাথায় তোমায় স্মরি , শুভ জন্মদিন ।
শহীদ বুদ্ধিজীবি মুনীর চৌধুরী , লিলি চৌধুরী দাম্পত্যের মধুর দিনগুলোতে


EmoticonEmoticon