হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি খাতা! আর তাতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। সময় নষ্ট না করে বিশেষ দলও তৈরি করে ফেলেছিল কলকাতা পুলিশ। তার পর তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু হয়েছিল কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়। শেষ পর্যন্ত এক পুরনো বইয়ের দোকান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল কয়েকটি খাতা। কিন্তু তা-ও সব ক’টা নয়! বইয়ের দোকানদারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ পৌঁছে গিয়েছিল বইপাড়ারই এক মুদিখানার দোকানে। সেখানে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, হারানো খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তৈরি ঠোঙায় সর্ষে বিক্রি করছেন ওই মুদিখানার দোকানদার! তিনি জানিয়েছিলেন, সাত কিলো ওজনের ওই রদ্দি কাগজপত্র তিনি কিনেছিলেন সাড়ে ১২ টাকায়! শেষ পর্যন্ত যেটুকু অক্ষত ছিল, উদ্ধার করা হয়েছিল তা। যিনি খাতা হারানোর অভিযোগ করেছিলেন, হারানো জিনিস উদ্ধারের খুশিতে পুলিশকর্তাকে নিজের বাবার লেখা একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইয়ের নাম ‘রূপসী বাংলা’, কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। বইয়ের উপরে লেখা ছিল, ‘কৃতজ্ঞতার সাথে মঞ্জুশ্রী দাশ।’ তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০ সাল।
৩৮ বছর আগের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন ডিসি ডিডি (২) ও প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘জীবনানন্দ দাশের প্রথম জীবনের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি খোয়া গিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রীদেবী। যত দূর মনে পড়ছে, তিনি মেচেদা থেকে লোকাল ট্রেনে ফিরছিলেন। ট্রেনের বসার সিটের তলায় রাখা সুটকেসেই জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছিল। অনেক খাতা ছিল। যখন হাওড়া স্টেশনে নামেন, তখন দেখেন ওই সুটকেসটি নেই। সুটকেসচোর ভেবেছিল গয়না বা টাকাপয়সা আছে। কিন্তু সে সব কিছু না পেয়ে রদ্দি কাগজ হিসেবে বেচে দিয়েছিল। তবে হারানো পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ উদ্ধার করা গিয়েছিল। পুরোটা পাওয়া যায়নি!’’ জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির একটা অংশ বাক্স করে আর ফেরত আনা যায়নি। ফলে জানা যায়নি, চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপিতে আরও কী কী অলৌকিক-শব্দবিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল!
কাউকে দেখানোর জন্য নয়, নিজের জন্যই যেন লেখাগুলো লিখতেন। লিখে ট্রাঙ্কভর্তি করে রাখতেন। ছাপাতে দেওয়ার আগে ওখান থেকেই বার করে দিতেন। ছোটবোন সুচরিতা খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন তাঁর। কখনও কখনও তাঁর সামনে তিনি বার করতেন ওই ট্রাঙ্কের লেখা। বাকিরা সেই অর্থে কিছু জানতেনই না। তাঁর জীবদ্দশায় সব ক’টি কাব্যগ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা মিলিয়ে বড়জোর সাড়ে তিনশো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি ট্রাঙ্কভর্তি সব লেখাই তো তাঁর মৃত্যুর পরে উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো যেন একটা আলাদা জগৎ,’’ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে বসে কথাগুলো বলছিলেন অশোকানন্দের পুত্র অমিতানন্দ দাশ। জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য, পুত্র সমরানন্দ, কন্যা মঞ্জুশ্রী অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, দেশভাগের ক্ষত নিয়ে এ দেশে আসার পরে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িতেই জীবনানন্দ কিছু দিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ল্যান্সডাউন রোডের (বর্তমানে শরৎ বসু রোডের) এক ভাড়াবাড়িতে তিনি চলে যান। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িতেই ট্রাম-দুর্ঘটনার দু’দিন আগে হন্তদন্ত হয়ে এসে জীবনানন্দ জানতে চেয়েছিলেন, সকলে ঠিক আছেন কি না। কারণ, রাস্তায় কার কাছ থেকে যেন শুনেছেন, পরিবারের কারও ট্রাম অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সকলে ঠিক আছেন শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।
আকাশে মেঘ দেখে বালক জীবনানন্দ ভাইকে বলতেন, তিনি একটা মনপবনের নৌকা তৈরি করবেন। সে দিনও কি জীবনানন্দ আকাশে মেঘ দেখে মনপবনের নৌকার কথা ভাবছিলেন? না হলে কেন ট্রামের অবিরাম ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ, ট্রাম চালকের চিৎকার শুনতে পাবেন না তিনি! ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর জখম জীবনানন্দকে রাস্তা থেকে তুলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন অপরিচিতেরা। সেখানেই আট দিনের লড়াই।
মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারাটা আকাশ জুড়ে’।
মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারাটা আকাশ জুড়ে’।
সেই ট্রামটি এখন আর নেই! এক সময়ে আগুন লেগেছিল। তাতেই পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ট্রামটি।
নেমেসিস? হবে হয়তো। না হলে কবির ‘ঘাতক’ ট্রাম নিজেই আগুনে কেন ভস্মীভূত হবে!
শহরের প্রাণঘাতী ট্রামলাইনে তাঁর পথ হাঁটা থেমেছিল, আবহমানের শব্দস্রোত থামেনি!
নেমেসিস? হবে হয়তো। না হলে কবির ‘ঘাতক’ ট্রাম নিজেই আগুনে কেন ভস্মীভূত হবে!
শহরের প্রাণঘাতী ট্রামলাইনে তাঁর পথ হাঁটা থেমেছিল, আবহমানের শব্দস্রোত থামেনি!
‘সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী’, কিন্তু হয়তো সেই আবহমানের খোঁজে বেরিয়েই জীবনানন্দ আর ফেরেননি! বাংলা কবিতার নির্জন চরাচর ধরে জীবনানন্দ হেঁটে গিয়েছেন দূরে, দূরতম দ্বীপে, একাকী, নিঃসঙ্গ অবস্থায়। তাঁর গা থেকে খসে খসে পড়েছে বাংলা কবিতার অবিশ্বাস্য সব লাইন, অসম্ভব সব শব্দ। তার পর সে সব শব্দ মিশে গিয়েছে আলপথে,
মাঠের ধারে, ধানসিড়ি নদীর কিনারে। আর তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন এ বাংলায়, দুই বাংলার বিস্তীর্ণ চরাচরে— মাটির ভিতর মাটি হয়ে, ফসলের ভিতর ফসল হয়ে, পাখির ভিতর পাখি হয়ে...
মাঠের ধারে, ধানসিড়ি নদীর কিনারে। আর তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন এ বাংলায়, দুই বাংলার বিস্তীর্ণ চরাচরে— মাটির ভিতর মাটি হয়ে, ফসলের ভিতর ফসল হয়ে, পাখির ভিতর পাখি হয়ে...
EmoticonEmoticon