সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের কাছে একটি সুপরিচিত নাম, ছাত্র আন্দোলনের অগ্রসর চিন্তার বলিষ্ঠ প্রতিনিধি। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, তেজোদিপ্ত ছাত্র আন্দোলনের স্বর্ণালী পটভূমিতে ১৯৮৪ সালের ২১ জানুয়ারি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ। অন্যায়-অসত্য ও দুঃশাসনের কবলে পীড়িত, লাঞ্চিত মানবতার মুক্তির সংগ্রামে লড়াকু ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার প্রত্যয় নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের অভ্যুদয় ঘটে। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণি এবং শোষনের স্বরূপ উন্মোচন করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ছাত্রসমাজের সামনে তুলে ধরে মুক্তির সঠিক আদর্শ ও সংগ্রামের অভ্রান্ত কৌশল। ঘোষনা করে শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়ন, গণতান্ত্রিক শাসন- ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং যাবতীয় শোষন- বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষে আপোষহীন সংগ্রামের সুদৃঢ় প্রত্য্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শ্ব লক্ষ্য সামমে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মনে করে, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা সকল মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার বাস্তবায়ন এবং একটি শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের দেশবাসী সুদীর্ঘকাল থেকে লড়াই করছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। বহুবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। মনুষ্যত্বের মর্যাদা নিয়ে বঁেচে থাকার নিশ্চয়তা আসেনি। বরং যতই দিন যাচ্ছে, জনজীবনে সংকট ততই বাড়ছে। অভাব-অনটন, বেকারত্ব, সামাজিক অনাচার ও ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় মানুষ এখন দিশেহারা।
দেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার বিস্তারে সরকারের উদ্যোগ নেই। রাষ্ট্রীয় বাজেটে সামরিক খাতসহ অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ বরাদ্দ প্রতি বছর বাড়ছে। অপচয় বাড়ছে। অথচ শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া হয় না। নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি অন্তহীন সংকটে জর্জরিত। শিক্ষা উপকরনের দাম, ছাত্র বেতন ক্রমশঃ বাড়ছে। অন্যদিকে ধনীর সন্তানদের জন্যে কিন্ডার গার্টেন, প্রিপারেটরী স্কুল, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল, ক্যাডেট কলেজ, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ব্যায়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ‘যার টাকা আছে, সেই শিক্ষা পাবে’- এ নীতির ভিত্তিতে শিক্ষাকে পরিণত করা হয়েছে বিলাসী পণ্যে। শাসকশ্রেণি চায় না মানুষ শিক্ষিত হোক। তারা জনগণকে অজ্ঞানতার ঘোর অন্ধকারে বন্দি করে রাখতে চায়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মনে করে, এই সংকট জনজীবনের অন্যসব সংকটের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের সমাজ শ্রেণি বিভক্ত। একদিকে মুষ্টিমেয় ধনী, অন্যদিকে সংখ্যাগরিরষ্ঠ গরীব। দেশের মোট সম্পদের ৯৫ ভাগের মালিক ধনিক শ্রেণি। তারা জায়গা- জমি, কল-কারখানা, অফিস-আদালত সর্বত্রই মানুষের শ্রমকে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজে লাগায়। মেহনতি মানুষের নিশিদিন হাড়ভাংগা পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে উৎপাদিত সম্পদ ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাৎ করে ধনিক শ্রেণি আকাশচুম্বি সম্পদের মালিক হয়। পক্ষান্তরে, মেহনতি মানুষ নিজেদের উৎপাদিত সম্পদের উপর অধিকার হারিয়ে নামমাত্র মজুরিতে মানবেতর জিবন যাপনে বাধ্য হয়। এ শোষণ ও বৈষ্ম্যমূলক ব্যবস্থার নাম পূঁজিবাদ। পঁুজিবাদী ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিক্ষার অধিকার এবং শিক্ষা শেষে সৎ, উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা পাবে না। স্বাধীনতা অর্জনের পর বার বার সরকার পরিবর্তন হলেও, প্রতিটি সরকারই ধনিক শ্রেণির শোষণের স্বার্থে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সযত্নে রক্ষা করেছে।
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র
ফ্রন্ট দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বাস করে, বিদ্যমান পঁুজিবাদী ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান- শিক্ষা-চিকিৎসার সর্বজনীন অধিকারসহ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তার জন্য চাই সঠিক রাজনীতি, সঠিক সংগঠন। শ্রেণিবিভক্ত পঁুজিবাদী সমাজে শোষক শ্রেণির স্বার্থ ও শোষিত মানুষের স্বার্থ এক নয়। শোষক বুর্জোয়া শ্রেণি চায় প্রচলিত পঁুজিবাদী ব্যবস্থা বহাল রেখে মেহনতি মানুষকে নির্মমভাবে শোষন করার প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে। আর শোষিত মেহনতি মানুষ চায় পঁুজিবাদী ব্যবস্থা ভেংগে শোষনের শৃং্খল থেকে মুক্ত হতে। শ্রেণিস্বার্থ যেহেতু এক নয়, সেহেতু রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলও শ্রেণি নিরপেক্ষ নয়। প্রতিটি দল এবং তার রাজনীতি অবশ্যই কোন না কোন শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করছে। একইভাবে প্রতিটি ব্যক্তি চিন্তায় ও ক্রিয়ায় সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে হোক, কোন না
কোন শ্রেণির পক্ষে ভূমিকা রাখছে। ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র সংগঠন এবং ছাত্রদের ক্ষেত্রও একই কথা সমান স্ত্য। তাই ছাত্রদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন পক্ষে যাবে। শতকরা ৯৫ জন শোষিত মানুষের পক্ষে, নাকি শতকরা ৫ জন শোষকের পক্ষে?
EmoticonEmoticon