মার্কসবাদকে আদর্শ গ্রহন করা সত্বেও যারা পার্টি গঠন করার জন্য আত্মনিয়োগ করল,তাদের মধ্যে সমচিন্তা পদ্ধতি, সম-চিন্তা, সম বিচার ধারা ও সম উদ্দেশ্যমুখীনতা এবং যৌথ নেতৃত্বের মূর্ত ধারনা গড়ে তোলার দীর্ঘ ও জটিল সংগ্রামটি এড়িয়ে যাবার ফলে যেটা আমি আগেই বলেছি, এই পার্টি কতগুলো পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও ব্যক্তির গৃহীত রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে শুধুমাত্র, রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্মে, পরিনত হয়েছে।
কমিউনিস্ট হিসাবে নিজেদের পরিচয় দেওয়া সত্বেও এই পার্টির নেতা ও বেশিরভাগ কর্মী তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নিজের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হন এবং নেতাদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত অহমবোধ এবং বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের অভিরূপ 'পলিটিক্যাল ক্যারিয়ারিজম এর (রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার)এক একটি প্রতিমূর্তি।
খবর নিলেই জানতে পারবেন পার্টির মধ্যে এদের প্রত্যেকের এক একটি গ্রুপ আছে। যতক্ষণ এই গ্রুপগুলি পরস্পর আপোষ করে, মানিয়ে নিয়ে চলতে পারে ততক্ষণ পার্টিটিও ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু যখন সেটা সম্ভব হয় না, তখনই পার্টিটি বিভক্ত হয়ে গিয়ে আবার একটা আলাদা পার্টিতে পরিনত হয়।অথচ, গ্রুপের এই ঝগড়ার জন্য পার্টিটি যখনই আলাদা হয়ে যায়, সাধারন মানুষ ও কর্মীদের কাছে তা আড়াল করে রাখার জন্য নেতারা সবসময়ই রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ধূয়া তুলে এটা করেন। নেতারা এসব সচেতনভাবে করেন কি করেন না, সেটা বড় কথা নয়। দলের মধ্যে ব্যক্তিবাদের প্রভাব প্রধান হয়ে দেখা দিলেই গ্রুপ মানসিকতা, উপদলীয় চক্রান্ত, নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রভৃতি বুর্জোয়া ভাবধারা বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া গুলিও কার্যকরীভাবেই দলের মধ্যে বজায় থাকতে বাধ্য।
এই প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আপনাদের বলে রাখা দরকার বলে মনে করি।ভারতবর্ষের মতো একটি বহুউপজাতি (nationalities) অধ্যুষিত দেশে যেখানে উপজাতি মানসিকতা জনসাধারনের মধ্য যথেষ্ট পরিমান বিদ্যমান এবং গনতান্ত্রিক দাবি দাওয়ার ভীত্তিতে সমস্ত প্রকারের লড়াই চলা সত্বেও আমার মতে যে মানসিকতা আরও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত আমাদের দেশে কাজ করবে, সেখানে শুধু ব্যক্তিবাদের প্রভাবই গ্রুপ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে থাকে।তাই আদর্শগত কেন্দ্রীকতা গড়ে তোলার প্রশ্নটি পার্টি অভ্যন্তরে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা ও বজায় রাখা এবং ব্যক্তিবাদী ঝোক ও গ্রুপের রাজনীতিকে পরাস্ত করার একটি প্রধান শর্ত।
একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি --দলের মধ্যে গ্রুপ বা উপদলীয় মনেভাবের প্রশ্রয় দিতে পারে না।কারন,গ্রুপ মানেই হচ্ছে সমান্তরাল( parallel) আর সমান্তরাল মানেই হচ্ছে পার্টির অভ্যন্তরে আলাদা আলাদা সমান্তরাল চিন্তাধারা যা একটি পেটিবুর্জোয়া পার্টির মধ্যেই সম্ভব হতে পারে।
একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টিতে এ জিনিস চলতেই পারে না। বরং একটি কমিউনিস্ট পার্টিতে গ্রুপ মনোভাব গড়ে ওঠার কারনগুলিকে দূর করার ব্যাপারে ব্যক্তিবাদের প্রভাব থেকে প্রতিটি কর্মী ও নেতাকে মুক্ত করার জন্য পার্টির অভ্যন্তরে যে যৌথ ও সচেতন সংগ্রাম পরিচালিত হয়, তাকে প্রতিটি মুহূর্তে জীবন্ত রাখতে হয়।
তাদের কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে যে গ্রুপ আছে, তা নাম্বুদ্রিপাদও অস্বীকার করতে পারেননি।তবে কংগ্রেসের মধ্যে যে বিভিন্ন গ্রুপের দ্বন্ধ আছে তার সাথে নিজেদের দলের মধ্যে গ্রুপের অবস্থানের প্রকৃতিগত পার্থক্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কংগ্রেসের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের দ্বন্দ্ব হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ;আর তাদের মধ্যে গ্রুপ আছে, তা ক্ষমতা র দ্বন্দ্বকে ভীত্তি করে গড়ে ওঠেনি ---তার মতে তা গড়ে উঠেছে পার্টির অভ্যন্তরে চিন্তার বিভিন্ন ধারাকে (different trends of thinking) ভিত্তি করে।
আর ও ভালো কথা স্বপক্ষে যুক্তি করতে গিয়ে তিনি জানেন না যে, বাস্তবে একটি কঠোর সত্যকেই তিনি স্বীকার করে ফেলছেন, যদিও আমি জানি, একথা তারা অস্বীকার করতে চাইবেন না, কিন্তু সত্যিকারের একজন মার্কসবাদী লেনিনবাদী হলে এ তো তার অজানা থাকার কথা নয়, যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে চিন্তার বিভিন্ন ধারা মানেই হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণী চিন্তাধারা।
এ কথা ঠিক যে কোন একটা বিষয়কে ভীত্তি করে একটি বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির অভ্যন্তরেও পার্থক্য হতে পারে, কিন্তু সে পার্থক্য হচ্ছে একই বিচারধারা বা চিন্তাধারা, অর্থাৎ একই চিন্তা প্রক্রিয়ার কাঠামোর মধ্যেই পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব। একটি কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে এ ধরনের পার্থক্য বা দ্বন্দ্বের কোন অস্তিত্ব কোন অবস্থথাতেই চিন্তাপদ্ধতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারার অস্তিত্বকে বুঝায় না।
অথচ নাম্বুদ্রিপাদ বলছেন, তাদের মধ্যে যা পার্থক্য তা চিন্তা র বিভিন্ন ধারাকে প্রতিফলিত করছে।চিন্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারার প্রশ্নটি যে সরাসরি শ্রেনীগত চিন্তাপদ্ধতির সাথে জড়িত ---এ কথা তিনি জানেন না অথবা নিজেদের ডিফেন্ড করার ঝোকে তা র খেয়াল ছিল।না।
মনে রাখতে হবে, কমিউনিস্ট পার্টি একটি বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া পার্টির মত নিছক কতগুলি ব্যক্তি এবং গ্রুপ এর সমষ্টি নয়,।
লেনিনি একটি কমিউনিস্ট পার্টিকে জীবন্ত দেহের (living organism) সাথে তুলনা করেছেন।
অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি একটা মেকানিক্যাল হোল না,এটা একটা অরগ্যানিক হোল,প্রাণহীন যন্ত্র নয়,একটি জীবন্ত সত্তা, ঠিক যেমন মানব দেহ ---এটা একটা মনোলিথিক অরগ্যানিজম এর একটা স্নায়ু কেন্দ্র বা মস্তিষ্ক centre of nerves or brain আছে। জীবন্ত দেহের এটাই হল কেন্দ্রবিন্দু বা পরিচালিকা শক্তি। এই মস্তিষ্কই সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গগুলিকে পরিচালনা করে।আবার, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং ইন্দ্রিওগুলিও sense organ তাদের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিভিন্ন প্রক্রিয়াা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করছে।মস্তিষ্কের সাথে ইন্দ্রিয় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলির এই সম্পর্কটি দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী পরিচালিত। একটি কমিউনিস্ট পার্টির গঠনও এইরকম।
একটা সত্যতিকারের কমিউনিস্ট পার্টিতে নেতার সাথে র্যাঙ্ক আ্যান্ড ফাইলের সম্পর্ক, কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে সেল থেকে শুরু করে পার্টির অন্যান্য বডিগুলির সম্পর্ক হল মস্তিষ্কের সাথে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়গুলির সম্পর্কের মতো।।আবার নিচু থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত এই সকল পার্টবডিগুলিও আলাদা আলাদাভাবে কতগুলো কর্মী বা নেতা র সমাবেশ মাত্র নয়।প্রত্যেকেরই নিজস্ব নিজস্ব ক্ষেত্র সেন্টার অফ আ্যাট্রাকসান,বা নেতা আছে।
এই সমস্ত পার্টিবডিগুলি এবং সমস্ত কর্মী ও নেতা র সম্মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যে যৌথ জ্ঞান গড়ে ওঠে, আমি আগেই বলেছি, সেই যৌথ জ্ঞানের ধারনা যেহেতু বিমূর্ত নয়, সেহেতু পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব , অর্থাৎ কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে নেতা র মধ্য দিয়ে এই যোথ জ্ঞানের প্রকাশ সর্বশ্রেষ্ঠ রুপ নেয় ----তিনিই হচ্ছেন দলের চিন্তানায়ক, নেতা শিক্ষক, ও পথপ্রদর্শক। এই নেতা বিভিন্ন নেতাদের মধ্যে চুক্তির দ্বারা,বা তাদের মধ্যে আপোষের রুপে বা জোড়াতালি দিয়ে ঠিক হয় না।এই নেতা পার্টির অভ্যন্তরে যৌথ ও সচেতন সংগ্রাম অর্থাৎ যৌথ নেতৃত্বের বাস্তবীকৃত ও বিশেষীকৃত ধারনা গড়ে তোলার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়।
মনে রাখতে হবে, কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে লিডারশিপ এর এই ফেনোমেনন, প্যারালাল সমান্তরাল লীডারস্ এর ফেনোমেনন নয়,এটা লিডার অব দি লিডারস -এর নেতাদের মধ্যে নেতার ফেনোমেনন।
লেনিনের জীবদ্দশায় সিপি এস ইউতে লেনিন ছিলেন সকল নেতাদের নেতা। তিনিই ছিলেন দলের চিন্তানায়ক, নেতা, শিক্ষক ও পথ প্রদর্শক। লেনিন যখন অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী, স্ট্যালিন পার্টির সাধারন সম্পাদক, তখনও লেনিন ছিলেন দলের নেতা ও শিক্ষক।এটা স্ট্যালিনও মনে প্রাণে স্বীকার করতেন। চীনের পার্টিতেও মাও সেতুংই দলের চিন্তানায়ক ও নেতা।একেই বলা হয় যৌথ নেতৃত্বের যাথার্থ্য রুপ অর্থাৎ যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত রুপ।
কিন্তু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী এই পার্টি গুলির মধ্যে কোন পার্টিতে কে সেই লিডার অফ দি লিডারস্ যাকে সেই পার্টিতে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্যরাও এবং পার্টির অন্যান্য সকল নেতারাও যথার্থভাবে পার্টির চিন্তানায়ক, শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক বলে মনে করেন.? বাস্তবে তাদের কেউই কারোর লিডার নয়।তারা সকলেই লিডার। এই পার্টির অভ্যন্তরে তাদের প্রত্যেক নেতারই প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও নীতিগত বিরোধ আছে।এরুপ পরিস্থিতিতে দলের নিন্মতম পার্টিবডি, অর্থাৎ সেল থেকে শুরু করে দলের উচ্চতম পার্টিসংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত কোন পার্টিবডিই সত্যিকার অর্থে অর্গানিজম এর রুপ নিতে পারে না। ফলে, এই অবস্থায় এক্সিজেন্সিতে অর্থাৎ প্রয়োজনের তাগিদে তারা একই পার্টির মধ্যে থেকে মেজরিটি সিদ্ধান্ত মেনে কোনমতে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যান।আর একেই ওরা বলেন যৌথ নেতৃত্ব।
EmoticonEmoticon