দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল ও সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও প্রধান বিচারপতির ভুমিকা এবং শাসকদলের নেতানেত্রীদের বাকবিতণ্ডা প্রতিদিনই পত্রিকা-টিভির খবরে আসছে। নির্বাচন কমিশনের "রোডম্যাপ'' নিয়েও চলছে নানান হিসেবনিকেশ।
গুম-খুন,ক্রশফায়ার,সরকারি মন্ত্রী- এমপি ও তার অনুগতদের সীমাহীন দূর্নীতি,লুটপাট, নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ,রামপালসহ জাতীয় সম্পদ লুট ও জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি,শ্রমিক নির্যাতন, ক্রমবর্ধমান জঙ্গী আতঙ্ক, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোষসহ একতরফাভাবে নির্বাচিত সংসদ ও বিরোধী মত দমনে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসীবাদী চেহারা দেখে জনগণ আর আস্থাশীল নয়।বিরোধী প্রধান দল বিএনপিও জনগণের নানা সঙ্কটকে সামনে রেখে আন্দোলনের মাঠে না থেকে ক্ষমতায় যাওয়ার বিভিন্ন ছক কষছে।তাহলে বিকল্প কি? এই বিষয়ে বিভিন্ন দল তার মতামত তুলে ধরবে এবং সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা চালাবে - এটাই স্বাভাবিক।
এমতাবস্থায় বামপন্থিরাও তাদের শক্তি সমাবেশ ও বিকল্প নির্মাণের লক্ষ্যে সিপিবি-বাসদ ও বামমোর্চার যুক্ত আন্দোলন ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। উদারনৈতিক শক্তির কাতারভুক্ত দল ও ব্যক্তিসমূহেরও নানা চেষ্টা ও পদক্ষেপ অগ্রসর হচ্ছে।
গত কিছুদিন আগে বামমোর্চার শরীকভুক্ত বাসদ( মার্ক্সবাদী) দলের মুখপত্র "সাম্যবাদ "- ৩য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা(আগস্ট ২০১৭) প্রচারিত হয়েছে।তাতে প্রধান কলাম- "বর্তমান পরিস্থিতি, পরিবর্তনের সংগ্রাম ও বিকল্প কোন পথে"- এই শিরোনামায় দলের মুখপত্রে ছাপানো হয়েছে।
লেখাটির শুরুর দিকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লেখা হলেও মাঝামাঝি জায়গায় বামপন্থি দল,নির্বাচন ও উদারনৈতিক শক্তিসমুহের বেশকিছু আলোচনা- সমালোচনা করা হয়েছে। সেই আলোচনাগুলোতে আলোকপাত করলে দেখা যাবে-লেখাটি এক সুবিধাবাদী অস্পষ্টতা এবং দ্বিচারীতায় পূর্ণ দলীয় অবস্থান ও বক্তব্য ছাড়া আর কিছুই নয়! লেখার বিভিন্ন অংশে বামরাজনীতি, নির্বাচন,উদারনৈতিক শক্তিগুলো নিয়ে একাধিক ও ভিন্ন বক্তব্য এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে,কোনটা যে তাদের অবস্থান তা ধরাই যাবে না। প্রয়োজন ও সুবিধামত তা পরিবর্তনও করা যাবে।
যেহেতু দলের মুখপত্রেই লেখাটা এসেছে, তাই এটা দলের বক্তব্য ও স্ট্যান্ড হিসেবেই তা ধরে নিতে হবে।
একেক করে বিষয়গুলো দেখা যাকঃ
ক.এক লেখাতেই নির্বাচন নিয়ে তারা তিন ধরণের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে।
১.প্রথম উপ-শিরোনামে লিখছেঃ
''জনগণ এই স্বৈরতান্ত্রিক ও গণবিরোধী শাসনের পরিবর্তন চায়। কিন্তু ভোটে এই পরিবর্তনের আশা দেখা যাচ্ছে না।কারণ - এই সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছে।"
( অর্থ্যাৎ- নির্বাচন বর্জন)
২. একই উপশিরোনামে বিকল্প হিসেবে বলছে-" গণভ্যুত্থানের পথে সরকার পরিবর্তন অথবা আপাত নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করা।"
( অর্থ্যাৎ নির্বাচনের প্রস্তুতিগ্রহণ)
৩.৩য় উপশিরোনামে বলছে- "জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তাতে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের লক্ষ্য হওয়া দরকার আন্দোলনের শক্তি ও বক্তব্য মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়া।"
( অর্থ্যাৎ- নির্বাচনে অংশগ্রহণ)।
একসাথে দেখলে মনে হবে কথাগুলো তো একই কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে কথাগুলোর ব্যবহারে চালাকিটা ধরা পড়ে।খেয়াল করুন -একই লেখায় অল্প ব্যবধানে কিভাবে ডিগবাজিটা দিলো?
যে দল আওয়ামী ফ্যাসীদুঃশাসনের কথা বলে ঢাকা/ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মতন স্থানীয় নির্বাচনের বিরোধীতা করলো(?) এবং যারা অংশ নিলো তাদের এই ফ্যাসীবাদের সহযোগী উল্লেখ করলো(?)- তাদের একজনের (গণসংহতি) সাথে মোর্চায় থাকলো এবং ২ বছর ঘুরতেই বাকিদের (সিপিবি ও বাসদ) সাথে জোটভুক্ত হলো(!)- এর ব্যাখ্যা কি?
সেই দল এখন বিকল্প হিসেবে ঐ আঃলীগের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন (যেখানে সরকার পরিবর্তনের বিষয়যুক্ত) আপাত নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথাই তো বলছে( গণভ্যুত্থানের একটা কথাও তো নেই )!!
আসলে তারা নির্বাচন করতেই চায়, কিন্তু এতোদিন মুখে যা বলে এসেছে কিংবা কর্মীদের মাঝে যা যা বলে উগ্রতা ছড়িয়েছে- তা থেকে পরিত্রাণ পেতে পিছনের এই দরজাটা খুলে রাখলো যাতে সময় এলেই নির্বাচনে যেতে পারে।
তারা জানে নির্বাচন এলে - সাকি ও সাইফুল হক ভাইরা তাতে অংশ নিবেন,এমনকি আরো বৃহত্তর জোটভুক্ত ও হতে পারেন- তাই একা ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার আতঙ্ক থেকেই এবং নীতিগত কোন দৃঢ় অবস্থান না নেয়ার ফলস্বরুপ - এই দ্বিচারীতা ও সুবিধাবাদী বক্তব্য ।অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরে প্রশ্ন উঠলে এই দুজনকে দেখিয়ে ও পরিস্থিতির চাপ বলে - বিরোধীতা ঠেকাবে ও নির্বাচনে হাজির হবে।
খ. লিবারেল বা উদারনৈতিক শক্তি সর্ম্পকে তাদের এই লেখায় গরম ও নরম- দুই ধরণের বক্তব্যই পাওয়া যায়।অবশ্য এর আগে তারা এই উদারনৈতিক শক্তি নেই বলেই প্রচার করতো বা তার অস্তিত্ব স্বীকার করতো না,পরে একমাত্র গণসংহতিকেই লিবারেলদের কাতারে ফেলতো।
১. ২য় শিরোনামে তারা লিবারেলদের নিয়ে বেশ গুরুতর অভিযোগ তুললোঃ
"শাসকগোষ্ঠী থেকে দলছুট বা তাদের একসময়ের সহযোগী কিছু নেতার ব্যক্তিপ্রচারের ভিত্তিতে গড়ে উঠা এসব তথাকথিত উদার গণতন্ত্রী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোন কর্মসূচি নেই।" ( অর্থ্যাৎ অস্তিত্ব আছে কিন্তু তথাকথিত!)।
আরো লিখছেঃ" জনগণের দাবিতে লড়াই- সংগ্রামের কোন উদ্যোগ- ঐতিহ্য নেই।এদের অনেকের ভাবমূর্তি বিতর্কিত, কেউ সামরিকতন্ত্রের সহযোগী ছিলেন,চক্রান্ত- ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সাথে যুক্ত বলে কারো কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আঃলীগ-বিএনপি জোটের বাইরে বিকল্প যে আকাঙ্খা মানুষের মধ্যে আছে বা শাসকগোষ্ঠীরও বিশেষ সময়ে প্রয়োজন হতে পারে,তাকে ব্যবহার করে এরা সামনে আসতে চায়।প্রয়োজনে আবার প্রধান দুই জোটের সাথে যোগাযোগ ও দর কষাকষি করে সুবিধা নিতে চায়। বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম ও তাদের কিছুটা প্রচার দিয়ে মানুষের সামনে বিকল্প হিসেবে খাড়া করে রাখে।... এজন্য শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের সাথে আতাঁত ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নেই।"
উদার গণতন্ত্রীদের নিয়ে এতগুলো অভিযোগ হেনে এবং ড. কামাল হোসেন যে আন্দোলনের লোক নন তা বুঝতে পেরে ৩য় উপশিরোনামে আবার বলে বসলো বিপরীত কথাঃ
" গণআন্দোলনের ধারায় অন্য কোন গণতান্ত্রিক শক্তি যদি অংশগ্রহণ করে এবং জনগণের মাঝে যদি ঐক্যের তাগিদ সৃষ্টি হয়,তখন বামপন্থিদের সাথে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোরও যুগপৎ ও অভিন্ন লক্ষ্যে আন্দোলন হতে পারে।" বাহ! কি চমৎকার! একদিকে আগের প্যারায় এসব লিবারেলদের সাথে " নির্বাচনী ঐক্যে" গণআন্দোলনে ফলপ্রসূ হবে না(?) এবং বামপন্থিদের জন্যে তা আত্মঘাতি উল্লেখ করে পরের প্যারা তাদের সাথে একেবারে যুগপৎ(!) এমনকি অভিন্ন লক্ষ্যে আন্দোলন(!)
তাহলে আর এসব অভিযোগের আর কোন গ্রহণীয় যুক্তি থাকে কি?এইসব সমালোচনার কার্যকারিতা কোথায়?
আসলে এই দলত্যাগীরা ( দল ছেড়েছিলো শিবদাস ঘোষ নিয়ে,আর এখন মার্ক্সবাদী!) দলে থাকতে এবং বের হয়ে গিয়েও বুঝতে পারে নি- লিবারেল ডেমোক্রেটদের সাথে ঐক্য বলতে কি বোঝায়? তারা ধরেই নিয়েছে যে- শুধু কামাল হোসেন,বি. চৌধুরী বা মাহমুদুর রহমান কিংবা তাদের দলগুলোই হচ্ছে একমাত্র উদারনৈতিক ব্যক্তি বা শক্তি- তাই এই ''তথাকথিত" শব্দপ্রয়োগ ও সতর্কভিযান!
এই লিবারেল ডেমোক্রেট শক্তি হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায় - ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক,অধ্যাপক চাকুরীজীবীসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যারা বড় পুঁজির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হেরে যায় এবং দ্বন্দ্ব ও আপোষ করে টিকে থাকতে চায়। সমাজে এদেরই এক অংশ লিবারেল ডেমোক্র্যাট এবং আরেক অংশ সোশ্যাল ডেমোক্রেট হিসেবে বুর্জোয়াদের সাথে কখনো দর কষাকষি ও শ্রমিকশ্রেণির সাথে কখনো আন্দোলনে নামে। এরা বুর্জোয়া সমাজে আইনের স্বাধীনতা, বিচারের নিরপেক্ষতা, সুশাসন,নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বললেও সমাজের আমূল পরিবর্তন চায় না। কামাল হোসেন,বি.চৌধুরীরা হচ্ছেন এদের প্রতিনিধি।এদের নিয়ে তাই যতটুকু পারা যায়,আন্দোলনে কমিটেট করাটাই বিপ্লবী শক্তির কাজ। যাতে এরা সরে গেলেও এদের সাথে যু্ক্ত মানুষদের আন্দোলনমুখী করা যায় এবং জনগণের সামনে তাদের চিন্তা ও আদর্শ উন্মোচন করা যায়।
আর তা ধরতে না পেরেই তাদের একজন কেন্দ্রীয় নেতা আ.ক. ম জহিরুল ইসলাম (যিনি দলের বিভিন্ন সমাবেশ ও জোটের কর্মসূচিতে প্রতিনিধিত্ব করেন) তার ফেসবুকে আমাদের জানাচ্ছেন- লিবারেল বলে কিছু নেই!( দল বলে এককথা আর নেতা শোনায় আরেক কথা।কোনটা ঠিক?)।
জহির ভাই তাঁর ফেসবুকে গত ১৬ আগস্ট " বাম ঐক্যের সমস্যা-৩ নিয়ে লিখলেনঃ" আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যুদ্ধ যেমন নেই, বাজার দখল করার জন্য উপনিবেশও নেই।ফলে সেদিন যে বুর্জোয়াদের মধ্যে লিবারেল অংশ ছিলো তাও নেই। কেন নেই?
অবাধ প্রতিযোগিতার বাজার একচেটিয়া বাজারে পরিণত হয়েছে সেজন্য নেই।"
ref:Jahirul Islam.
aug 16 at 11:33 a.m (Facebook post)..[ লিংক কমেন্ট বক্সে দেয়া আছে]
বুঝুন এইবার! এই হচ্ছে মার্ক্সবাদীদের নেতার জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ!
অন্যদিকে দল( দলীয় মুখপত্র সাম্যবাদ) যখন বলছে - উদার গণতন্ত্রীদের( লিবারেল) সাথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুগপৎ ও অভিন্ন আন্দোলনের কথা, তখন প্রায় একই সময়ে দলের নেতা জানাচ্ছেন- লিবারেল নেই! তাহলে যুগপৎ ও অভিন্ন আন্দোলন কার সাথে?
এই হচ্ছে এই মার্ক্সবাদী দলের গোঁজামিল! যখন যেমন তখন তেমন!
আর এই সুবিধাবাদী প্রবণতার মুল কারণ ও উৎস হচ্ছে- দলের মধ্যেকার "প্র্যাগমেটিক ট্রেন্ড"।
একদিন দলত্যাগকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে ডগম্যাটিক ( গোঁড়ামী) প্রবণতা যার ফলাফল হিসেবে তৈরী করেছে "প্রয়োজনবাদী" কার্যপ্রণালী।আর এইভাবেই তৈরী করে সুবিধাবাদ।
একইরকম না হলেও এই গোঁড়ামীচিন্তার সুবিধাবাদের উদাহরণ ভারতে আগেই তৈরী হয়েছে।সেখানে শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠা এসইউসি সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তৃণমুল কংগ্রেসের সাথে থাকলেও বেশ সরগরম বিরোধীতা করে আসছিলো।অথচ আন্দোলনের শেষে নির্বাচনকালীন সময়ে করলো নির্বাচনী জোট।আর এই জোটে থাকার স্বার্থে মমতা ব্যাণার্জীর মতন এক বুর্জোয়া নেত্রীর তোষামদে নেমে পড়লো তাদের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষ ঘোষ।একজন কম্যুনিস্ট নেতার এই ধরণের স্তুতিবাচ্য যে কতটা স্থূল ও বুর্জোয়া চাটুকারিতায় নেতৃত্বকে নামিয়ে দেয়- দলের কর্মীদের অনেকেই ধরতে পারলো না অন্ধভক্তির কারণে।সেখানেই যদি ইলেকশানে এইধরণের চেহারা হয় শিবদাস ঘোষের নিজের পার্টির তাহলে তার চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠা দলত্যাগীদের এই পার্টির এমন পরিণতিই স্বাভাবিক।
#পরিশেষে যেনতেনভাবে শুধু দ্রুত কিছু করে ফেলার অস্থিরতা কিংবা হতাশা থেকে নয় - এই তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি ও দ্বিচারী সাংগঠনিক অবস্থান, অবজেকটিভ রিয়েলিটি ধরতে না পারা ও র্যাঙ্ক এন্ড ফাইলের অন্ধ গোঁড়ামীজাত নিম্ন রাজনৈতিক মান থেকেই জন্ম নেয় রাজনৈতিক সুবিধাবাদ।যার নজীর বিশ্ব কম্যুনিস্ট আন্দোলনে অতীতে বহু রয়েছে ।
EmoticonEmoticon