রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

রোহিঙ্গ্যা আত্মপরিচয়ের প্রবক্তাঃ ঢাবির প্রাক্তন ছাত্র আব্দুল গফফার ।

বার্মার আরাকানে বাঙালীরা - সুনির্দিষ্টভাবে বললে, চট্টগ্রামী বা চিটাগাঙ্গ্যারা - 'রোহিঙ্গ্যা' নামে স্বীকৃতি  পেতে চায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে যোগ দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। ভারতের আসাম থেকে সিলেটের বাঙালীরা (যারা এখনও নিজেদেরকে সিলেটী বলে পরিচয় দেয় এবং অন্যাঞ্চলের বাঙালীদেরকে 'বেঙ্গলি' বলে রেফার করে থাকে) রেফারেণ্ডাম বা গণভৌট দিয়ে পাকিস্তানে (কিছু অংশ এখনও ভারতের আসামে রয়ে গিয়েছে) যোগ দিতে পারলেও বার্মার আরাকানের বাঙালীদের সেই সুযোগ ছিলো না।

১৯৪৭ সালে আরাকান থেকে আসানসোল পর্যন্ত বাঙালীর রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয় আত্মপরিচয় বোধের উন্মেষ ঘটেনি। তখন ধর্মকে ভিত্তি করেই হিন্দু-মুসলিম জাতিবোধ ক্রিয়া করছিলো সমগ্র বাঙালী জাতির মধ্যে।

ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক বাঙালী জাতীয় আত্মপরিচয়বোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্ব-অগ্রগামী হচ্ছে পূর্ব-পাকিস্তান তথা পূর্ব-বাংলার বাঙালীরা। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের পিতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে "উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা" বলে ঘোষণা-কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল মতিন ওরফে ভাষা মতিনের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এক নবযুগের সূচনা ঘটে।

১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব-বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলের মধ্যেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে, যা ভারত পশ্চিমবঙ্গে কিংবা বার্মার আরাকানে ঘটেনি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের যোগ দেওয়ার মুসলিম চেতনা নিয়ে আরাকানের বাঙালীরা ব্যর্থ হলে, তাদের মধ্যে নতুন আত্মপরিচয় আবিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। আর, সেই প্রয়োজন মেটাতেই উদ্ভাবিত হয় রোহিঙ্গ্যা আত্মপরিচয়।

Rohingya (রোহিঙ্গ্যা) শব্দটির প্রথম রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতা উত্তর বার্মা রাষ্ট্রের কাছে আরাকানের আব্দুল গফফার এমপি প্রথম তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদেরকে 'রোহিঙ্গা জাতি' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে বার্মা সরকারের কাছে আবেদন করেন। ১৯৪৮ সালের ২০শে নভেম্বর তিনি লিখেনঃ

“We the Rohingyas of Arakan are a nation. We maintain and hold that Rohingyas and Arakanse are two major nations in Arakan. We are a nation of nearly nine lakhs more than enough population for a nation; and what is more we are a nation according to any definition of a nation with our own distinctive culture and civilization, language and literature, art and architecture, names and nomenclature, sense of value and proportion, legal laws and moral codes, customs and calendar, history and traditions aptitude and ambitions, in short, we have our distinctive outlook on life and of life. By all canons of international law the Rohingyas are a nation in Arakan.”

অর্থাৎ, "আমরা রোহিঙ্গ্যারা একটি জাতি। আমরা জানি ও মানি যে রোহিঙ্গ্যা ও আরাকানী হচ্ছে আরাকানের দুই প্রধান জাতি। আমরা প্রায় নয় লাখ জনসংখ্যার একটি জাতি, যে সংখ্যাটি একটি জাতি হওয়ার জন্যে যথেষ্ট; এবং বড়ো কথা হচ্ছে জাতির যে-কোনো সংজ্ঞানুসারে আমরা একটি জতি, যার আছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও সভ্যতা, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্য, নাম ও নামকরণ, মূল্যবোধ ও ন্যায়বোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রবণতা ও প্রত্যাশা, সংক্ষেপে, জীবনের ওপর ও জীবন বিষয়ে আমাদের আছে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গী। আন্তর্জাতিক আইনের সকল বিধি মোতাবেক রোহিঙ্গারা আরাকানের একটি জাতি।"

পেশাগত জীবনে আব্দুল গফফার প্রথমে ছিলেন একজন শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনি আকিয়াবে স্কুলসমূহের জেলা পরিদর্শক ছিলেন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। পরবর্তীতে, ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এক বছরের জন্যে তিনি বুথিংদংয়ের টাউনশিপ অফিসার ছিলেন।

আব্দুল গফফার বার্মার স্বাধীনতার আগে, ১৯৪৭ সালে, সাংবিধানিক সভার সদস্য নির্বাচিত হন বুথিংদং থেকে এবং ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী বার্মা স্বাধীন হলে তিনি ইউনিয়ন অফ বার্মার প্রতি আনুগত্য শপথ গ্রহণ করে পার্লামেণ্টের সদস্য হিসেবে প্রতিনিধিত্ব অব্যাহত রাখেন।

১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি 'চ্যাম্বার অফ ন্যাশন্যালিটিজ' তথা আইনসভার উচ্চকক্ষে আকিয়াব জেলার উত্তরাঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৯ সালে নু-তিন সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পার্লামেণ্টারী সেক্রেট্যারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আব্দুল গফফারের জন্ম ১৯১০ সালে আরাকানের বুথিংদংয়ের জেলার রোয়াঙ্গা দাউং গ্রামে। তিনি ১৯২৪ সালে চট্টগ্রাম সিনিয়ার মাদ্রাসা থেকে ইসলামিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৩০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯৩৩ সালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড পাস করেন। ১৯৬৬ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়।

রাজনৈতিক বিশ্বাসে আব্দুল গফফার ছিলেন ইসলামবাদী। তিনি জামিয়ত-ই-উলেমার সদস্য ছিলেন। বার্মার বাঙালীদের রাজনীতিতে কোনো ধর্মনিরপেক্ষ ধারা ছিলো না বলে, আব্দুল গফফারদের ইসলামবাদী চিন্তার আলোকে ১৯৪৭ সালের মুসলিম আত্মপরিচয়ের ধারা অব্যাহত থাকে।

১৭/০৯/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড


EmoticonEmoticon