শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

গৌতম বৌদ্ধ কি ছিলেন ?

বৌদ্ধ দর্শনে ঈশ্বরের কোন স্থান নেই। বস্তুত বুদ্ধদেবের জীবনের চরম লক্ষ্য ও ব্রত ছিল জগতে যে দুঃখ-দুর্দশা হচ্ছে তা থেকে মানুষের মুক্তি লাভ করা। তিনি তত্ত্ববিষয়ক আলোচনা পরিহার করে চলতেন। বুদ্ধদেব কর্মনিয়মকে সকলের উপরে স্থান দিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করতেন কর্মের দ্বারাই জগতের দুঃখের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। কর্মের ফলেই জীবের উদ্ভব। বস্তু এবং চিন্তা সবই কর্মফল। সুতরাং সৃষ্টিকর্তা রূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের কোন প্রয়োজন নেই। তাছাড়া বৌদ্ধ দর্শন হল প্রাকৃতবাদী। অর্থাৎ যা আমাদের প্রত্যক্ষের বিষয় তাই সত্য। কিন্তু অস্তিত্ব সম্পূর্ণ উপলদ্ধির ব্যাপারে ঈশ্বর প্রত্যক্ষের বিষয় নয়। তাই ঈশ্বরের ধারণা সত্য নয়। সুতরাং বুদ্ধ মতে, জগতের আড়ালে কোন অতীন্দ্রিয় সত্তা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। বুদ্ধদেব বলেন- “জগৎ যদি ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্টি হতো তবে জগতে কোন পরিবর্তন বা বিনাশ দেখা দিত না, দুঃখ ও বিপদ কিছুই থাকতো না। দুঃখ, সুখ, রাগ-দ্বেষ প্রভৃতি যা কিছু মানুষের মধ্যে দেখা যায় তা যদি ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট না হয়ে থাকে তবে ঈশ্বরের মধ্যেও এ গুণগুলো আছে।” এক্ষেত্রে ঈশ্বরকে পূর্ণ ও অনবদ্য বলা যায় না। বুদ্ধ মতে, জগতের সৃষ্টির জন্য কোন সচেতন কর্তা মনে করার কোন প্রয়োজন নেই। বীজ থেকে যেমন চারা জন্মে তেমনি জগৎ প্রবাহের কারণ হলো জগৎ।

বিভ্রান্ত শুরু :
গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর তিন মাস পর রাজা অজাতশক্রর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজগৃহের বেভার পর্বতের সপ্তপণী গুহায় মহাকাশ্যপ স্থবরের সভাপতিত্বে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাঁচশত অরহৎ স্থবির অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সাত মাস এ অধিবেশন চলে। তার মৃত্যুর পর বৌদ্ধ দর্শনের  আদর্শ ও রীতিনীতি নিয়ে বুদ্ধদেবের শিষ্যগণের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল। এই মতভেদ দূর করার জন্য বৈশালীতে বৌদ্ধগণের সম্মেলন হয়েছিল। কিন্তু সেই সম্মেলন সফল না হওয়ায় বৌদ্ধরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় আচার ব্যবহারের কঠোরতা শিথিল করার পক্ষপাতীত নিয়ে হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের জন্ম হলো। রক্ষণশীল হীনযানরা উদারপন্থী মহাযানদের সংঘ থেকে বের করে দেন। হীনযানরা বৌদ্ধকে একজন মানুষ হিসেবে স্বীকার করেন। একজন শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু মহাযানরা বৌদ্ধকে ঈশ্বর বা জগতের ত্রাণকর্তা হিসেবে সাধারণ ঈশ্বর প্রত্যাশী মানুষের আশা আকাঙ্খা পূরণের কর্তা হিসেবে কল্পনা করেন। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের পূজার মত বুদ্ধের পূজা করতে পারেন এবং তাঁর করুণা বা সাহায্যপ্রার্থী হতে পারেন। শ্রীলংকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দক্ষিণদেশে হীমযান বৌদ্ধরা এবং চীন, জাপান ও কুরিয়া প্রভৃতি উত্তর দেশে মহাযানরা বসবাস করে। পালি ভাষায় রচিত ত্রিপিটক হীমযানদের গ্রন্থ এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাযান সূত্র হলো মহাযান বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ। গৌতম বুদ্ধদেবের মূলধারা যে ত্রিপিটক তা আমরা সকলেই কমবেশী জানি এবং মানি। বৌদ্ধ নিজেও ঈশ্বর তত্ত্বালাপে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি এ-কে অকাজ ভাবতেন অথচ মহাযানরা বৌদ্ধকে ঈশ্বর কল্পনা করে সেই অকাজটাই করল। এবং ইহা ত্রিপিটক বিরোধী তাতে আর সন্দেহ থাকার কোন কারণ নেই।

বাংলাদেশের বৌদ্ধ :
আমরা যে বৌদ্ধ ধর্ম দেখি জানি তা মূলত ত্রিপিটক থেকে নয়, বরং মহাযান সূত্র থেকে সংগ্রহীত। কারণ আমাদের দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার লাভ করে বাঙালি মহাস্থবির শীলভদ্র এবং বাঙালি অতীশ দীপষ্কর শ্রীজ্ঞান নামক ব্যক্তির দ্বারা। এরা দুইজনেই ছিলেন মহাযান মতের অনুসারী। কালক্রমে আমাদের শিক্ষায় এই ধারাটি যুক্ত হয়েছে। ফলে বৌদ্ধ দর্শন সম্প্রকিত এক বিভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। তাই আজ গৌতম বৌদ্ধও বিতর্কিত তিনি আস্তিক না-কি নাস্তিক?

তথ্য : ভারতীয় দর্শন


EmoticonEmoticon