শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সোভিয়েত ও সিনেমা

বিপ্লব ও শিল্প-দুটোই মহৎ সৃষ্টিশীলতা। এই দুটো কাজই পাল্টিয়ে দেয় মানুষের চিন্তা ও সভ্যতা।পরিবর্তন করে অতীতের সাথে বর্তমানকে।মানুষ আগে যা করে নি বা ভাবে নি,তা নিয়ে আসে তার ভাবনার পরিধিতে ও সাধ্যের সীমানায়। ১৯১৭ সালের অক্টোবর রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তেমনই এক ঘটনা-যার আগের পৃথিবী ও পরবর্তী দুনিয়া আর এক থাকে নি। জারশাসিত রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণী সর্বপ্রথম নির্মাণ করে মেহনতি মানুষের দুনিয়া। শোষণ-বঞ্চনা,ভূৃমিদাসত্ব, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিপীড়ন ও সাম্রাজ্যবাদী ধ্বংসযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্বের বুকে প্রথম ঘোষণা করলো-পুঁজিবাদী মালিকী ব্যবস্থার  মৃত্যু পরোয়ানা!

এই বিপ্লব রুশদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনই শুধু নির্মাণ করে নি, নির্মাণ করেছে সোভিয়েত শিল্প-সাহিত্য,চিত্রকলা-ভাষ্কর্যসহ নয়া সাংস্কৃতিক জগত।সৃষ্টি করেছে সোভিয়েত জনগণের নান্দনিকতা ও শিল্পরূপ রস ও রীতি। যে শিল্প সাহিত্য এতোদিন ছিলো শুধু উপরতলার একদল মানুষের বুদ্ধিমত্তার কারবার, তাকে করেছে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনের অংশে। এই সৃষ্টিজগতের এক নব অধ্যায়-সোভিয়েত সিনেমা।

রুশ শিল্প-সাহিত্যের গল্প, কবিতা, নাটক,উপন্যাসের  মতন এই সিনেমার ছিলো না তেমন সগৌরব অতীত। মূলত দ্বিতীয় নিকোলাই জারের আমল থেকে রাশিয়ায় চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা শুরু হয়।১৮৯৬ সালের মে মাসে মস্কো ও সেন্ট পিটাসবার্গ শহরে ফ্রান্সের ''ল্যুমিয়ের ব্রাদার্সে'র চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। নির্বাক ও গল্পবিহীন হলেও এই চলচ্চিত্র শহরের মানুষের উপর দারুণ প্রভাব ও ব্যাপক আগ্রহ  তৈরী করে।

জার শাসনে জুরিখে নির্বাসনলকালে অক্টোবর বিপ্লবের মহান নেতা কমরেড লেনিনও প্রথম পরিচিত হন এ শিল্পের সঙ্গে। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রসমূহ ও জাতি সর্ম্পকে সংবাদ এবং ধারণা পেতে মূলত লেনিনের এই চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে হাজির হওয়া।এই শিল্পের শক্তিমত্তা উপলব্ধি করতে পেরে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় লেনিন তাই এই শিল্পের জাতীয়করণ করে চেয়েছেন প্রোলেতারিয়েতের অন্যতম হাতিয়ারে তৈরী করতে।১৯১৯ সালে এই জাতীয়করণ করা হয়। সরকারি সিনেমা কমিটি ও ক্রুপস্কায়ার তত্ত্বাবধানে শিক্ষাবিভাগের অধীনে  একটি চলচ্চিত্র উপ-বিভাগ গঠন করা হয়।

বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিপরীতে সর্বহারা শ্রেণীর সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শের ভিত্তি রচনা ছিলো সোভিয়েতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বুর্জোয়া সিনেমার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মুনাফা।সিনেমা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়াশ্রেণি এই নতুন সৃষ্টিকলাকে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলো। আমেরিকা ও ইউরোপের সিনেমা মালিকেরা টুঁটি চেপে ধরলো এই সৃজনশীল সম্ভাবনার।সস্তা চিত্তবিনোদন, হাল্কা যৌনতা প্রদর্শনী ও উগ্র অপরাধমূলক বিষয়বস্তুগুলোই প্রাধান্য ছিলো বুর্জোয়া সিনেমামহলে।
সোভিয়েত সিনেমা মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা প্রকাশের ও বিকাশের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলো।
জহির  রায়হানের ভাষায়ঃ" আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে স্মরণীয় অবদান হচ্ছে দুটো- একটি সিনেমার জন্ম অপরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম।দুটোই বিপ্লব।একটি চারুকলার ক্ষেত্রে, অপরটি সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে।" (জহির রায়হান- ১৯৬৭ সালে সোভিয়েতের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে  প্রকাশিত সাময়িকী 'তরঙ্গ' )।

সোভিয়েত সিনেমার প্রথম ফসল হচ্ছে সার্জেই আইজেনস্টাইনের 'Strike'(১৯২৪) সিনেমাটি। যদিও অস্ত্রভস্কির নাটক  "Enough simplicity in every wiseman" ছবি পরিচালনার মাধ্যমে তার হাতেখড়ি হয় সিনেমায়। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন প্রকৌশলী।১৯১৮ সালে পেত্রোগাদেে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে সোভিয়েত রেড আর্মিতে যোগ দেন। যুদ্ধের পর সোভিয়েত শিল্পের কাজে যোগ দেন। সোভিয়েত সিনেমার জন্ম মুহুর্তে তাঁর পুরোধা পরিচালকরা ছিলেন কিন্তু একেকজন ভিন্নজগতের মানুষ। আইজেনস্টাইন প্রকৌশলী, পুদভকীন ছিলেন কেমিস্ট, ডোভজেঙ্কো ছিলেন স্কুলশিক্ষক, জীগান ছিলেন অভিনেতা, কুলেশভ ও ইয়াকুতভীচ ছিলেন পেইন্টার, আলেক্সান্দারভ ছিলেন সিনেমা অপারেটর।ভিন্ন পেশার লোক হলেও এদের হাত ধরেই এগুতে থাকে সোভিয়েত সিনেমা এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে নিয়ে আসে অভিনব কলাকৌশল।বাণিজ্যিক প্রসার ও শিল্পের বাজার নয়, সৃষ্টিশীল সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে এই শিল্প গড়ে তোলেন।নতুন ফিল্ম থিওরী নিয়ে আসে এই নতুন ও সৃজনশীল নির্মাতারা।
Strike ছবির মাধ্যমে আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রে প্রথম সম্পাদনা রীতির উদ্ভব করেন।একে Montage of attraction বলা হয়। সাধারণ ছবির প্রতিটি স্পটে এমন উপাদান থাকে যা এককভাবে এবং তার পূর্বের ও পরের শর্টের সঙ্গে যুক্তভাবে দর্শকের মন ক্রমাগত আকৃষ্ট ও উদ্বেলিত করে। আদিক প্রতীকের ব্যবহার এবং উপস্থাপনায় ছবিটি অভিনব।
চলচ্চিত্রে প্রথম প্রায়োগিক ভাষা গল্প নিয়ে হাজির হন মার্কিন নির্মাতা ডি. ডব্লিউ গ্রিফিথ। তাঁরর পরিচালিত Birth of a nation(১৯১৫) ছিল প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র। কিন্তু সিনেমাটি ছিলো একটা বর্ণবাদী চরিত্রের।এতে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবমাননার ও বর্ণবিদ্বেষী গোষ্ঠী '' কু- ক্ল্যাক্স- ক্যান(Ku Klax klann)দের মাঝে উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই ছবি প্রদর্শিত হওয়ার পর আমেরিকার বহু শহর ও প্রেক্ষাগৃহে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। John Howard Lawson তাঁর The creative proocess বইয়ে গ্রিফিথকে নিয়ে লেখেন- " He(Grifith) felt that the fate of huminity is a factor of history.... he couldn't believe that huminity would ever control its own destiny. His philosophic views were colored by the vulgariation of Darwin's theories current at the time... critics have praised the film's technical brilliance and deplored it's reactionary treatment of the Negro struggle for freedom. It's advance techniques and backward socialcial content often conosidered as fixed opposites."
এতেই বোঝা যায় কি ছিলো সেই সময়ে বুর্জোয়া চলচ্চিত্রের চেহারা!

১৯২৫ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি আইজেনস্টাইন পরিচালিত বিখ্যাত ছবি "Battleship potempkin"। ১৯০৫ সালে পটেমকিন জাহাজের নৌ-বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে এই সিনেমাকে ধরা হয় পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র  হিসেবে। পটেমকিন জাহাজের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় এবং তা দমন করা হয় নিষ্ঠুরভাবে।কিন্তু ব্যর্থতার ও থাকে বিজয়ের শিক্ষা। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে শ্রমিক-কৃষক-সিপাহী জনতাকে নিয়ে বলশেভিক পার্টি সেই ইতিহাস তৈরী করে। আইজেনস্টাইন দেখাচ্ছে- নিয়তির কাছে মানুষ হারতে পারে না।মানুষই হচ্ছে সেই নিয়তির নিয়ন্তা।এখানে নায়ক হলো জীবন।নায়ক হলো মানুষ।একা ও একজন নয়- অনেক ও অসংখ্য মানুষ। ১৯৫৮ সালে ব্রাসেলসে  "আর্ন্তজাতিক চলচ্চিত্র উৎসব"য়ে এই ছবিকে ''The best film of all times and peoples" এবং আইজেনস্টাইনকে সর্বকালের সেরা চিত্রপরিচালক হিসেবে  ভূষিত করা হয়।" অক্টোবর", "জেনারেল লাইন" তাঁর অন্যতম সেরা নির্মাণ।

আইজেনস্টাইনের পটেমকিন সিনেমাটি নির্মিত হওয়ার পর শুধু যে চলচ্চিত্র মহল কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নেই সাড়া ফেলেছিল তা নয়,এর প্রভাব পড়ে খোদ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বে।হিটলার জার্মানিতে ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কারণ,তাদের আশংকা ছিলো- যারা এই ছবিটি দেখবে তাদের উপর সোভিয়েত ও মার্ক্সবাদের প্রভাব বাড়বে এবং জার্মান জনগণ কম্যুনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়বে।এতেই বোঝা যায়-শিল্প মাধ্যম হিসেবে সোভিয়েত সিনেমার আদর্শিক শক্তি ও বিশ্বমান। আজ সারা পৃথিবীতেই ফিল্ম স্কুলগুলোতে এই সিনেমাটি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি হিসেবে রাখা হয়।

সোভিয়েত সিনেমার মৌলিকত্ব ও কারিগরি অভিনবত্ব নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আরেকজন শ্রেষ্ঠ নির্মাতা হলেন পুদভকিন।পুরো নাম সেভলদ ইনারিয়োভিচ।আইজেনস্টাইনের মতই সিনেমায় মন্তাজ ব্যবহারের সাথে সাথে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক প্রাধান্য দিয়ে ছবি তৈরী করতে থাকেন।নিতান্তই দিনমজুর ঘরে জন্ম নেয়া পুদভকিন ছিলেন একজন রসায়নবিদ, বিপ্লবের  পরে লেভ কুলেশভের স্টুডিওতে কাজ শিখেন।পুদভকিনই প্রথম দেখান-পেশাদার অভিনেতাদের পরিবর্তে কিভাবে সংঘবদ্ধ জনতাকে দিয়েও অভিনয় করানো যায়।Death Ray ছবিতে পুদভকিন অভিনেতাদের শ্রমিক না সাজিয়ে আসল শ্রমিকদের নিয়েই কাজ করেন।১৯২৮ সালে সবাক চলচ্চিত্র শুরু হয়।এই সময় মন্তাজের ফ্লুইডিটি,ক্রসকাটিং,ইমেজারি নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন পুদদভকিন।কমেডি প্রধান ছবি Chess fever(১৯২৫) তাঁর প্রথম ছবি হলেও ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত 'Mother(১৯২৬)' ছবিটি পুদভকিনকে চলচ্চিত্র জগতে সামনের কাতারে নিয়ে আসে।

চলচ্চিত্রে শ্রেণিচেতনা নির্মাণের এই পরিচালককে 'সোশালিস্ট রিয়েলিজম'য়ের প্রবক্তা হিসেবে ধরা হয়।সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরেন বলশেভিক আদর্শ। 'The end of St. petersberg (1927), storm of asia তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার আহবানে 'মা' ছবিতে ব্যবহৃত 'মোরগের ডাক' শর্টটি তৈরী করে শ্রমিকমুক্তির লড়াইয়ের প্রস্তুতির সিম্বলিক হিসেবে।মহান অক্টোবর বিপ্লবের পটভূমিতে আইজেনস্টাইনের ' অক্টোবর' ছবিতে দেখানো হয়- একটা সেতু ভেঙ্গে যাওয়ার মাধ্যমে বুর্জোয়া কেরেনস্কি সরকার কিভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে কিংবা জার রাজত্বেরর পতন ঘটছে একটা 'সাদা রাজকীয় ঘোড়া' সেই সেতু দিয়ে ধীরে ধীরে নিচে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যায়নের ভেতর দিয়ে।

সোভিয়েত চলচ্চিত্র সম্পর্কে বুর্জোয়া শিল্পের অভিযোগ - এ বড্ড বেশি প্রচারধর্মী! শিল্পীর স্বীয় সত্ত্বাকে কেড়ে নেয় রাষ্ট্রীয় প্রেসক্রিপশনে! কিংবা বিধি-নিষেধ আরোপ করে প্রোপাগান্ডা হয় সত্যিকার শিল্প হয় না!! ইত্যাদি! এই অভিযোগগুলোর সারবত্তা  যাই হোক বিষয়টা বুঝতে হলে একদিকে যেমন সোভিয়েত সমাজের বাস্তবতা বোঝা দরকার তেমনি বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গীর অসারতাও জানাটা প্রয়োজনীয়।
বিপ্লবের পর সদ্য ভূমিষ্ট এই নতুন শ্রমিক রাষ্ট্রটিকে পড়তে হয় সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের মুখে।পুরানো সমাজের অভ্যন্তরে ক্ষমতা হারানো কুলাকরা সহ জার আমলের যে সকল সামন্তচক্র, আমলতন্ত্র ছিলো তারাও সামিল ছিলো এই আক্রমণে।সোভিয়েতকে এই দুইমুখী আক্রমণের পাশাপাশি জনগণকে যুক্ত করে অর্থনৈতিক উৎপাদন বিনির্মাণের কাজটাও করতে হয়।সে সময় সোভিয়েত রাষ্ট্র ছিলো সম্পূর্ণ একা,পাশে দাড়ঁনোর মতন কোন শক্তিই ছিলো না।রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্যারি কমিউনের( ফ্রান্স ১৮৭১) অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।অন্যদিকে জনগনের মাঝেও রয়েছে হাজার বছরের পুরানো সংস্কার,চিন্তা,অভ্যেস- রীতিনীতি। সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রেও ছিলো নানা জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ। ফলে এই নতুন পরিস্থিতি, গৃহযুদ্ধ,শত্রুর আক্রমণ -এসবের বিরুদ্ধে সোভিয়েত জনগনকে ঐক্যবদ্ধ করা ছিলো খুবই জটিল ও দূরহ কঠিন কাজ।যা এর আগে কোন রাষ্ট্রকেই করতে হয় নি।শুধু  বুর্জোয়া সমাজই নয়,পূর্বতন সকল সমাজের চিন্তা ও সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক নিয়মাদি পাল্টানোর সংগ্রামের ভিতর দিয়েই সোভিয়েত তথা শ্রমিকশ্রেণিকে এগুতে হয়।এখানে দ্বন্দ্বটা শ্রেণির সাথে শ্রেণির;ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার নয়।সামাজিক স্বার্থের সাথে ব্যক্তি স্বার্থের।আর এই পরিস্থিতিতেই সোভিয়েত সিনেমা।

সোভিয়েত সিনেমাগুলোর প্রকৃতি,বিষয়বস্তু বুঝতে হলে সমাজের গতি-প্রকৃতি ও সামাজিক -রাজনৈতিক এবং বৈষয়িক বিষয়গুলোকে কিভাবে তা প্রতিফলিত করে তাও বোঝা প্রয়োজন।

বিপ্লবের পূর্বতী সময়, ১৯০৫ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং মহান বিপ্লবের পটভূমিতে নির্মিত হতে থাকে সোভিয়েতের শুরুর দিকের ছবিগুলো। 'strike', 'mother','battleship potemkin'য়ের মতো কালজয়ী সিনেমাগুলো তৈরী হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগগুলোতে রাশিয়ার জনগণের য়ে মহাযজ্ঞ পুরো দেশকে ইউরোপের পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে নিয়ে আসে সমৃদ্ধির পথে সেই যৌথ খামার, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো সিনেমার উপজীব্য হয়ে উঠে পরবর্তী সময়ে। নির্মিত হয় 'Counter plan','  The road of life', 'Golden hills'। এসময় আমরা দেখতে পাই ভ্লাদিমির প্যাট্রভের 'the storm', সার্জেই জেরাসীমভের 'We are from Krosdat', ভাসিলি ব্রাদার্সের ' Chapayev' মুভিগুলো।

২য় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ান চলচ্চিত্রের এক কঠিন পরীরীক্ষা শুরু হয়।হিটলারের ফ্যাসীবাহিনী সোভিয়েত আক্রমণে পর্যুদস্ত পিতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ে চিত্রনির্মাতারা ক্যামেরা ফেলে হাতে তুলে নেন রাইফেল।এই ২য় বিশ্বয়ুদ্ধে ফ্যাসীবাদী-সাম্রাজ্যবাদী য়ুদ্ধের উপর পরবর্তীতে বিশ্বের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায় ' Ballard off soldiers, 'Ivan's childhood ', ' ordinary facism', 'story of flaming years' য়ের মত আরো সোভিয়েত সৃষ্টি। এই সৃষ্টিকালীন সময়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কির।Ivan's childhood য়ের মধ্য দিয়ে খ্যাতিমান এই নির্মাতা সর্ম্পকে সর্বকালের অন্যতম সেরা পরিচালক ইংমার বার্গম্যান বলেছেন-" আমার কাছে তারকভোস্কিই সেরা পরিচালক।তিনি চলচ্চিত্রে নতুন ভাষা দিয়েছেন।এ এমনই এক ভাষা যা চলচ্চিত্রের প্রকৃতির জন্য খুবই উপয়োগি।এই ভাষা সিনেমায় জীবনের প্রতিফলন ও স্বপ্ন তুলে ধরে"।
'আন্দ্রে রুভলব', 'স্টকার', 'সোলারিস' ছবিগুলো তারকভস্কির উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর কয়েকটি।

সোভিয়েত সিনেমার নানা সমালোচনার মধ্যেও এমন কিছু মহৎ শিল্পকর্ম নির্মাণ ঘটে যা বুর্জোয়া মিডিয়া ও অস্বীকার করতে পারে নি।সার্জেই বন্দুরাকের 'War and peace' সম্পর্কে ফরাসী La figaro পত্রিকা লেখেঃ 'Go to see War andnd peace; It is, of course, one of the most splendid works off arts.one of the most thrilling and memorable films ever work."
বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ ও শিল্পী চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন সোভিয়েত চলচ্চিত্রের অনুরাগী। জীগা ভার্তবের Enthusiasm সম্পর্ক চ্যাপলিনের মন্তব্যঃ''Never had I known that these mechanical sounds could be arranged to see so beautiful. I regard it as one of the most exhilarating symphonies I have heard".

সমাজতান্ত্রিক সমাজ কেমন হবে,কি নিয়ে লড়বে ভবিষ্যতের মানুষ তাও ছিলো সোভিয়েত সমাজ ও অক্টোবর বিপ্লবের আরেক ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ। মানুষে মানুষের সম্পর্ক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।এমনকি শিল্প-সংস্কৃতি ও যে সামাজিক দায়হীন কোন ভাবচর্চার বিষয় নয় তাও তুলে ধরে সোভিয়েত সিনেমা। "The Communist ", "I am twenty" ,"the journalist" সিনেমায় তুলে ধরা হয় সেই সমাজের প্রতিকৃতি। শ্রেণিভাবচেতনায় নির্মাণ ঘটায় শৈল্পিক চিত্র।

সোভিয়েত বিপ্লব গড়ে তুলেছিলো নতুন সমাজ। অবসান ঘটিয়েছিলো মানব সমাজের শোষন-বঞ্চনার যুগ।সভ্যতার নতুন অধ্যায় নির্মাণ করে মানুষকে দিয়েছিলো সত্যিকার মর্যাদা ও স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার।সোভিয়েত দেখিয়েছিলো সমাজের মুক্তি না ঘটলে সংস্কৃতির মুক্তি সম্ভব নয়। সোভিয়েত চলচ্চিত্র ও ছিলো সেই স্বপ্নময় দুনিয়ার সেলুলয়েড দর্পণ।

আজ সোভিয়েত নেই।প্রতিবিপ্লবী শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারা পৃথিবী আজ সাম্রাজ্যবাদী -পুজিঁবাদী ব্যবস্থায় শৃঙ্খলিত।প্রযুক্তির উৎকর্ষতা যত উন্নত হচ্ছে,ধসে যাচ্ছে তার অতীত সকল সৃষ্টি,মানবিকতা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা।৯০'য়ের সোভিয়েত পতনে উল্লসিত ধনবাদী ব্যবস্থা জেঁকে ধরেছে অস্ত্রের বাজার, বাজারী পণ্যে পরিণত করেছে মানুষের সকল নান্দনিকতা ও বৃত্তির সুকুমার চর্চা। তাই বিশ্বশ্রমজীবী মানুষকে আবারো দাঁড়াতে হবে- সভ্যতার স্রষ্টা হিসেবে, বাঁচাতে হবে মানবজাতিকে।সেই স্বপ্নের পৃথিবী গড়তে সোভিয়েত সিনেমা  মেহনতি বিশ্বকে ভবিষ্যত পথ দেখাবে।

জয়তু_সোভিয়েত_সিনেমা।

তথ্যসহযোগিতায়ঃ
*অক্টোবর বিপ্লব ও সিনেমা-জহির রায়হান।
*সেভলদ পুদদভকিন- ডেভিড গিলেস্পি।
*তারকভর্স্কি জীবনী।


EmoticonEmoticon