শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

গৌরী লঙ্কেশের প্রাক্তন স্বামী চিদানন্দ রাজঘাট্টার ফেসবুক পোস্ট।

1) মৃত্যু একটা ঘটনামাত্র , গৌরী যে কাজটা করে গিয়েছে , সেটাই আসল"-------
২ ) গৌরী লঙ্কেশ মৃত্যুর পর ওর জন্য যে সব বার্তা এবং প্রার্থনা এসেছে , তাদের মধ্যে ‘আত্মা ’, ‘মৃত্যুর পরে শান্তি ’, ‘স্বর্গ’ এ ধরনের শব্দ অজস্র৷ গৌরী সেগুলো পড়লে নির্ঘাত হেসে লুটিয়ে পড়ত৷ কে জানে ... হয়তো লুটিয়ে পড়ত না , কিন্ত্ত হাসত নিশ্চিত৷ উনিশ -কুড়িতেই আমরা ঠিক ফেলেছিলাম , মৃত্যুর পরে স্বর্গ-নরক একেবারে ফালতু বিষয় , পৃথিবীর বুকে যে স্বর্গ-নরক রয়েছে সেটাই বুকে বাজে বেশি ! সব সময় ঈশ্বরকে বিরক্ত না করে , তাঁকে বরং নিজের মতো থাকতে দেওয়াটাই ঠিক হবে৷ তবে , আমাদের এই সমঝোতার একটা দিকে এটাও ছিল যে , অন্যকে কখনও দুঃখ দেব না আমরা , বিশেষত পরিজনদের৷ তাঁদের বিশ্বাসে যদি আস্থা না -ও থাকে , তাঁদের সম্মান করে চলব৷ ব্যর্থ যে হইনি তেমনটা নয়৷ বয়সের দোষ কি এড়ানো যায় ! তবে , এই নীতি পরবর্তী সময়ে আমাদের অনেক উপকার করেছে৷ এই নীতির কারণেই পাঁচ বছরের প্রেম এবং পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনের পর বিচ্ছেদ সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট রয়ে গিয়েছে৷ কোনও আঘাত নয় , শুধুই পাশে থাকা৷
দু’জনের প্রথম দেখা ন্যাশনাল কলেজে , যা ছিল ভারতের যুক্তিবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর৷ এই আন্দোলনের হোতা ছিলেন আমাদের অধ্যক্ষ এইচ নরসিমাইয়া এবং শ্রীলঙ্কার যুক্তিবাদী আব্রাহাম কোভুর৷ সেই ভাবধারায় দীক্ষিত হওয়ার ফলে তরুণ বয়স থেকেই আমরা তথাকথিত ‘বাবা ’ (গডম্যান ), ‘মা ’ এবং কুসংস্কারকে দূরে সরিয়ে রাখতে শিখেছি , বিরুদ্ধ যুক্তি পছন্দ না হলেই প্রশ্ন তুলতে শিখেছি৷ এ সব নিয়ে আরও বলতেই পারি , তবে আপাতত গৌরী -হত্যার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে যতটুকু দরকার শুধু ততটুকুই৷ যুক্তিবাদীরা এখন উগ্র -সাম্প্রদায়িকদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে দাঁড়িয়ে৷ ধর্ম, রাজনীতি এবং জীবনের বিভিন্ন আগাছার (রূপকার্থে) সংস্পর্শে আসার আগে প্রথম যে বইটি আমরা একসঙ্গে শেষ করি , সেটি হল উইল ডুরান্টের ‘স্টোরি অফ ফিলোজফি ’৷ আমাদের দু’জনের কেউই মাতৃভাষায় (কন্নড় ) তেমন পারদর্শী ছিলাম না (সে সময় )৷ ফলে , সেই ভাষায় লেখা বিপুল সাহিত্যসম্ভারকে ভারাক্রান্ত হূদয়ে দূরে সরিয়ে আপন করে নিতে হয়েছিল ওডহাউস , গ্রাহাম গ্রিনদের৷ কিংবা , সত্যি বললে আপন করে নিতে হয়েছিল সেই সব কিছুকেই যেগুলো প্রিমিয়ার বুক শপের শানবাগ মহোদয় ২০ শতাংশ ছাড়ে আমাদের দিতেন (বাকিরা অবশ্য ১৫ শতাংশ ছাড় পেত )৷ কয়েক বছর পর অবশ্য গৌরী কন্নড়ে ফিরে যায় , সে কথায় পরে আসছি৷
এরই মাঝে , টেরি জ্যাকের গান উদ্ধৃত করে বললে , আমরা ‘স্কিন্ড আওয়ার হার্টস অ্যান্ড স্কিন্ড আওয়ার নি -স , লার্নড অফ লাভ দ্য এবিসি -স ’৷ ঠিক ক’বছর আগেই বেরিয়েছিল টেরি জ্যাকের ‘সিজন্স ইন দ্য সান ’৷ ডিলান আর বিট্লসের মাঝে এগুলোও গুনগুন করতাম আমরা৷ বহু বছর বাদে আমি ভারতীয় সঙ্গীতে ফিরে আসি , গৌরী অবশ্য সুরের মধ্যে ফারাক টের পেত না৷ এরিক সেগালের ‘লাভ স্টোরি ’ পড়ে আমরা হেসেছিলাম৷ প্রথম দিকে দেখা করতে বেরিয়ে সিনেমা দেখতাম৷ ‘আব্বা ’, ‘স্যাটারডে নাইট ফিভার ’ এবং ‘গান্ধী ’র মতো সিনেমা এভাবেই দেখা হয়ে গিয়েছিল৷ আবার কার্ল সাগান পড়া (এবং দেখার ) পর তো টিলার ওপর চড়ে এক বার বহুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম আমরা , অন্ধকারের বুকে খুঁজেছিলাম নক্ষত্র ৷
‘প্রাণবন্ত ’ শব্দটা ওর পক্ষে খুবই সংক্ষিন্ত৷ এই শব্দটুকু দিয়ে গৌরীর সত্তার এমনকী ছোট্ট একটা অংশও বোঝানো অসম্ভব৷ কলেজে আমার সিগারেট খাওয়াটা ও একেবারেই পছন্দ করত না৷ কয়েক বছর পর বেশ কিছুটা সময়ের জন্য যখন আমি এই বদভ্যাস থেকে দূরে , ততদিনে ও আবার সিগারেট ধরে ফেলেছে৷ একবার ও আমেরিকা এল , আমার সঙ্গে দেখা করতে (অবাক হলেন ! প্রাক্তন স্ত্রী দেখা করতে এল ? কী করব , ভালো বন্ধু ছিলাম যে !) আমি ওকে ঘরের মধ্যে সিগারেট খেতে বারণ করেছিলাম , কারণ মেঝেতে কার্পেট পাতা , তা ছাড়া সিগারেটের গন্ধ সহজে ঘর থেকে বেরও হবে না৷ তখন আবার ভয়ানক শীতের সময়৷
‘তুমি ঠিক কী চাও বলো তো , কী করব আমি ?’‘যদি একান্তই সিগারেট ফুঁকতে হয় , ছাদে যাও৷ ’‘কিন্ত্ত বাইরে তো বরফ পড়ছে , প্রচণ্ড ঠান্ডা !’‘তো ? কী করব !’‘তুমি একটা ***৷ আমার সিগারেট ধরার কারণ তো তুমিই !’‘ওহো ... তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত , কিন্ত্ত এখন সিগারেটটা ছাড়তে বলছি৷ ’‘ঠিকই৷ তুমি তো এখন হাড়ে -মজ্জায় মার্কিন !’‘এর সঙ্গে আমেরিকার কোনও সম্পর্ক নেই , এটা সুস্থ থাকার বিষয়৷ ’‘ধুস , আমি তোমার থেকে বেশি দিন বাঁচব৷ দেখে নিও৷ ’সেদিন গৌরী মিথ্যে বলেছিল৷
বিচ্ছেদের পরও আমাদের এই অটুট বন্ধুত্ব দেখে সবাই হতবাক৷ কারণ , ভারত হোক বা অন্য কোনও দেশ , বিচ্ছেদ সাধারণত তিক্তই হয়৷ আমাদেরও বিভিন্ন উত্তাল সময় গিয়েছে , কিন্ত্ত খুব অল্প দিনের মধ্যেই আমরা সে সব ‘অমিল ’ দূরে সরিয়ে ‘মিল ’-এর পথটাই খুঁজে নিয়েছিলাম৷ আদালতে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েও আমাদের দুটো হাত কাছাকাছি চলে গিয়েছিল , আঙুলগুলো জড়িয়ে ধরেছিল একে অপরকে৷ আইনজীবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন , রাস্তা যদি আলাদা করতে চান , তা হলে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো৷
কাজ মিটে যাওয়ার পর (মিউচুয়াল ডিভোর্স) আমরা এম জি রোডের ‘তাজ ’-এ মধ্যাহ্নভোজ করতে যাই৷ রেস্তোরাঁর নাম ছিল ‘সাদার্ন কমফোর্ট’৷
ব্যাপারটা বেশ মজারই ঠেকেছিল আমাদের কাছে৷ এই ‘কমফোর্টে’ই একে অন্যকে বিদায় জানাই আমরা৷ সেখান থেকে আমি প্রথমে দিল্লি , পরে মুম্বই, শেষে ওয়াশিংটন চলে যাই৷
প্রতিটি জায়গাতেই ও দেখা করতে এসেছিল আমার সঙ্গে , স্পষ্ট করে বললে , ঝগড়া করতে এসেছিল , জীবন নিয়ে , পৃথিবী নিয়ে ... দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে !ওর এই বিদ্রোহী স্বভাব সত্ত্বেও আমার মা -বাবা ওকে ভালোবাসত৷ ট্র্যাডিশনাল , রক্ষণশীল মানুষদের ক্ষেত্রে যেমনটা সচরাচর দেখা যায় না৷ আমাদের ডিভোর্সের পরও তাঁরা গৌরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন , সেও নিয়মিত কথা বলত তাঁদের সঙ্গে৷ এক আড্ডার দিনে , আমি ওকে আমার নতুন ‘প্রেম ’ সম্পর্কে বলছিলাম , ও তখন সব কাজ ছেড়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল , ‘হা ! যাই করো না কেন , এই পরিবারের প্রথম পুত্রবধূর খেতাব তুমি আমার থেকে কখনও কাড়তে পারবে না৷ ’ এ বছর ফেব্রুয়ারিতে যখন আমার মা মারা গেল , তখন গৌরী সেখানে ছিল৷ আমি তখনও বাড়ি ফিরতে পারিনি , ও শেষ কাজের প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে ‘ভিডিয়ো কল ’-এ দেখাচ্ছিল৷
ওর বাড়ির সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ঠিক একই রকম ছিল৷ আমাদের বিচ্ছেদের সময় এবং তার পরেও গৌরীর বাবার সঙ্গে আমার দেখা হত৷ তিনি শুধু বিখ্যাত লেখক , নাট্যকার এবং পরিচালকই ছিলেন না , তাঁর লেখা থেকে যুগযুগ ধরে রসদ পেয়ে আসছেন বিদ্রোহী লেখক এবং সাংবাদিকরা৷ ওর বোন কবিতা , আমরা অবশ্য ওকে ‘বেবি ’ বলেই ডাকতাম , সে এখন সিনেমা বানায়৷ কলেজে আমাদের প্রেমপর্বের শুরুর দিকে , গৌরীর কঠিন চেষ্টায় আমি সাহিত্যের লিটমাস টেস্টে পাশ করেছিলাম৷ তার পরই ওর পরিবারের সদস্য হওয়ার ছাড়পত্র জোটে আমার কপালে৷ তবে , এই পরিবার মানে শুধু লঙ্কেশরা নয় , এর সদস্য শহরের নামকরা সব লেখক , কবি , সাহিত্যিক ... সে একেবারে বুদ্ধিজীবীদের মেলা !আটের দশকের শুরুর দিকে প্রতি রবিবার এই বৈঠকী আড্ডাগুলো বসত , সঙ্গে তাস৷ খেলার খোরাক সামান্য হলেও আলোচনা উঁচু দরের হত৷
দারুণ লাগত , গৌরী অবশ্য মাঝেমধ্যে আসত৷ , এই টেবিলে ওই একমাত্র মহিলা ছিল ! গৌরীর বাবাকে আমি আপ্পা বলে ডাকতাম৷ প্রথম যখন ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় , তখন তিনি বোধহয় সবে প্রথম ছবিটি পরিচালনা করেছেন (অপূর্ব কিংবা পল্লবী , জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল ছবিটি )৷
জীবনের রঙিন অধ্যায়গুলো এ ভাবেই এগোতে থাকে৷ প্রেম , বিয়ে , বিচ্ছেদ , এমনকি আমার আমেরিকা চলে যাওয়ার পরও চলতে থাকে৷ দেশে ফিরলেই বসে যেতাম তিন জনে , সঙ্গে পেগ৷ সিনেমা থেকে রাজনীতি , কোনও কিছুই বাদ দিতাম না আমরা৷ ২০০০ সালে গৌরীর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান৷ সেদিনই নিজেকে ‘বাবার মেয়ে ’ বলে প্রমাণ করে গৌরী , পত্রিকার দায়িত্ব তুলে নিয়ে৷ শেষ দিন পর্যন্ত সেই লড়াইটা ও চালিয়ে গিয়েছে৷
আমার এত কিছু বলার উদ্দেশ্য একটাই, যাতে বোঝা যায় , গৌরী কোন পরিবেশে , কী ধরনের আদর্শে মানুষ হয়েছে৷ মৃত্যু এখানে একটা ঘটনা মাত্র৷ তারা যেটা করে গিয়েছে , সেটাই আসল৷ শেষের দিকে ওই রবিবাসরীয় তাসের আসরে গৌরীর উপস্থিতি কমে গিয়েছিল৷ কারণ , ততদিনে কট্টরপন্থী , ধর্মীয় উন্মাদদের সঙ্গে লড়াইয়ে ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ ও যে বাঁ দিকে ঝুঁকে ছিল , এ নিয়ে কারও মনে সন্দেহ ছিল না , কিন্ত্ত ওর ভাবনায় কোনও ভুল ছিল না৷ ও মনে করত , পৃথিবীতে হিংসার কোনও জায়গা নেই৷ যারা কাপুরুষ , তারাই হিংসার আশ্রয় নেয়৷
বছর আটেক আগে আমি বেঙ্গালুরুতে বাড়ি তৈরি করি , ভেবেছিলাম কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে ফিরে আসব৷ গৌরীর মনে হয়েছিল , বাড়িটা আমার একার পক্ষে দেখা সম্ভব নয় , পরিচারিকা দরকার৷ হঠাত্ একদিন ফোন করে ও বলে , ‘আমি একজনকে পাঠাচ্ছি৷ ও বিধবা , দু’টি বাচ্চা মেয়ে আছে৷ মেয়েদুটোকে দেখো , ওদের স্কুলে ভর্তি করে দিও৷ ’ হুকুম তামিল করেছি৷ ওর সেই উপহার , রামাক্কা , এখনও আমাদের সঙ্গে রয়েছে৷ ওর দুই মেয়ে আশা আর উষা কলেজের পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে৷ এমন শয়ে শয়ে আশা -উষারা বেঁচে গিয়েছে , শুধুমাত্র গৌরীর জন্য৷ কয়েক সন্তাহ আগে আমি এবং মেরি বাচ্চাদের নিয়ে দেশে এসেছিলাম৷ ও ফোন করে বলল , আসছে৷ কিন্ত্ত , সে বার দেখা করতে আসেনি৷ বলেছিল , ‘জানোই তো , ‘চাড্ডি ’দের (কট্টরপন্থীদের এই নামেই ডাকতো ) সঙ্গে লড়াই করা কি চাট্টিখানি কথা !’ একদিন ফোনে বলল , ছেলেকে নিয়ে আসছে৷ জানতে চাইলাম , ‘দত্তক নিলে না কি ?’ হেসে বলল , ‘কানহাইয়া কুমার , দেখো ওকে তোমার ভালো লাগবে ’৷
কিছুক্ষণ পরে ফোন করে বলল , ফ্লাইট লেট , ও আসতে পারবে না৷ সেই শেষ ওর গলা শুনেছিলামমৃত্যু একটা ঘটনামাত্র , গৌরী যে কাজটা করে গিয়েছে , সেটাই আসল এই সময় কলকাতা শুক্রবার ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ এরিক সেগালের ‘লাভ স্টোরি ’ পড়ে আমরা হেসেছিলাম৷ কার্ল সাগান পড়া (এবং দেখার ) পর টিলায় চড়ে বহুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম , অন্ধকারের বুকে খুঁজেছিলাম নক্ষত্র৷
১৫ ঘণ্টার উড়ানের পর এই মাত্র বিমান থেকে নামলাম৷ শয়ে শয়ে মেসেজে ভরে গিয়েছে ইনবক্স , সবেতেই গৌরীর কাজ এবং তাঁর উজ্জ্বল চিন্তাধারার প্রশংসা৷ আসলে ওর জীবনটাই খুব সুন্দর ছিল , লড়াই করেছিল মহত্ একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে৷ সে লড়াই ব্যর্থ হবে না৷ বিমানে বসে সর্বক্ষণই চোখের সামনে গৌরীর অজস্র ছবি আর কথা৷ চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ফেলে আসা মুহূর্তগুলো ৷


EmoticonEmoticon