বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সোভিয়েত ও সিনেমা... (পর্ব-১)

বিপ্লব ও শিল্প-দুটোই মহৎ সৃষ্টিশীলতা। এই দুটো কাজই পাল্টিয়ে দেয় মানুষের চিন্তা ও সভ্যতা।পরিবর্তন করে অতীতের সাথে বর্তমানকে।মানুষ আগে যা করে নি বা ভাবে নি,তা নিয়ে আসে তার ভাবনার পরিধিতে ও সাধ্যের সীমানায়। ১৯১৭ সালের অক্টোবর রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তেমনই এক ঘটনা-যার আগের পৃথিবী ও পরবর্তী দুনিয়া আর এক থাকে নি। জারশাসিত রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণী সর্বপ্রথম নির্মাণ করে মেহনতি মানুষের দুনিয়া। শোষণ-বঞ্চনা,ভূৃমিদাসত্ব, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিপীড়ন ও সাম্রাজ্যবাদী ধ্বংসযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্বের বুকে প্রথম ঘোষণা করলো-পুঁজিবাদী মালিকী ব্যবস্থার  মৃত্যু পরোয়ানা!
এই বিপ্লব রুশদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনই শুধু নির্মাণ করে নি, নির্মাণ করেছে সোভিয়েত শিল্প-সাহিত্য,চিত্রকলা-ভাষ্কর্যসহ নয়া সাংস্কৃতিক জগত।সৃষ্টি করেছে সোভিয়েত জনগণের নান্দনিকতা ও শিল্পরূপ রস ও রীতি। যে শিল্প সাহিত্য এতোদিন ছিলো শুধু উপরতলার একদল মানুষের বুদ্ধিমত্তার কারবার, তাকে করেছে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনের অংশে। এই সৃষ্টিজগতের এক নব অধ্যায়-সোভিয়েত সিনেমা।
রুশ শিল্প-সাহিত্যের গল্প, কবিতা, নাটক,উপন্যাসের  মতন এই সিনেমার ছিলো না তেমন সগৌরব অতীত। মূলত দ্বিতীয় নিকোলাই জারের আমল থেকে রাশিয়ায় চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা শুরু হয়।১৮৯৬ সালের মে মাসে মস্কো ও সেন্ট পিটাসবার্গ শহরে ফ্রান্সের ''ল্যুমিয়ের ব্রাদার্সে'র চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। নির্বাক ও গল্পবিহীন হলেও এই চলচ্চিত্র শহরের মানুষের উপর দারুণ প্রভাব ও ব্যাপক আগ্রহ  তৈরী করে।
জার শাসনে জুরিখে নির্বাসনলকালে অক্টোবর বিপ্লবের মহান নেতা কমরেড লেনিনও প্রথম পরিচিত হন এ শিল্পের সঙ্গে। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রসমূহ ও জাতি সর্ম্পকে সংবাদ এবং ধারণা পেতে মূলত লেনিনের এই চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে হাজির হওয়া।এই শিল্পের শক্তিমত্তা উপলব্ধি করতে পেরে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় লেনিন তাই এই শিল্পের জাতীয়করণ করে চেয়েছেন প্রোলেতারিয়েতের অন্যতম হাতিয়ারে তৈরী করতে।১৯১৯ সালে এই জাতীয়করণ করা হয়। সরকারি সিনেমা কমিটি ও ক্রুপস্কায়ার তত্ত্বাবধানে শিক্ষাবিভাগের অধীনে  একটি চলচ্চিত্র উপ-বিভাগ গঠন করা হয়।
বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিপরীতে সর্বহারা শ্রেণীর সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শের ভিত্তি রচনা ছিলো সোভিয়েতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বুর্জোয়া সিনেমার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মুনাফা।সিনেমা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়াশ্রেণি এই নতুন সৃষ্টিকলাকে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলো। আমেরিকা ও ইউরোপের সিনেমা মালিকেরা টুঁটি চেপে ধরলো এই সৃজনশীল সম্ভাবনার।সস্তা চিত্তবিনোদন, হাল্কা যৌনতা প্রদর্শনী ও উগ্র অপরাধমূলক বিষয়বস্তুগুলোই প্রাধান্য ছিলো বুর্জোয়া সিনেমামহলে।
সোভিয়েত সিনেমা মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা প্রকাশের ও বিকাশের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলো।
জহির  রায়হানের ভাষায়ঃ" আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে স্মরণীয় অবদান হচ্ছে দুটো- একটি সিনেমার জন্ম অপরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম।দুটোই বিপ্লব।একটি চারুকলার ক্ষেত্রে, অপরটি সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে।" (জহির রায়হান- ১৯৬৭ সালে সোভিয়েতের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে  প্রকাশিত 'তরঙ্গ')।
সোভিয়েত সিনেমার প্রথম ফসল হচ্ছে সার্জেই আইজেনস্টাইনের 'Strike'(১৯২৪) সিনেমাটি। যদিও অস্ত্রভস্কির নাটক  "Enough simplicity in every wiseman" ছবি পরিচালনার মাধ্যমে তার হাতেখড়ি হয় সিনেমায়। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন প্রকৌশলী।১৯১৮ সালে পেত্রোগাদেে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে সোভিয়েত রেড আর্মিতে যোগ দেন। যুদ্ধের পর সোভিয়েত শিল্পের কাজে যোগ দেন। সোভিয়েত সিনেমার জন্ম মুহুর্তে তাঁর পুরোধা পরিচালকরা ছিলেন কিন্তু একেকজন ভিন্নজগতের মানুষ। আইজেনস্টাইন প্রকৌশলী, পুদভকীন ছিলেন কেমিস্ট, ডোভজেঙ্কো ছিলেন স্কুলশিক্ষক, জীগান ছিলেন অভিনেতা, কুলেশভ ও ইয়াকুতভীচ ছিলেন পেইন্টার, আলেক্সান্দারভ ছিলেন সিনেমা অপারেটর।ভিন্ন পেশার লোক হলেও এদের হাত ধরেই এগুতে থাকে সোভিয়েত সিনেমা এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে নিয়ে আসে অভিনব কলাকৌশল।বাণিজ্যিক প্রসার ও শিল্পের বাজার নয়, সৃষ্টিশীল সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে এই শিল্প গড়ে তোলেন।নতুন ফিল্ম থিওরী নিয়ে আসে এই নতুন ও সৃজনশীল নির্মাতারা।
Strike ছবির মাধ্যমে আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রে প্রথম সম্পাদনা রীতির উদ্ভব করেন।একে Montage of attraction বলা হয়। সাধারণ ছবির প্রতিটি স্পটে এমন উপাদান থাকে যা এককভাবে এবং তার পূর্বের ও পরের শর্টের সঙ্গে যুক্তভাবে দর্শকের মন ক্রমাগত আকৃষ্ট ও উদ্বেলিত করে। আদিক প্রতীকের ব্যবহার এবং উপস্থাপনায় ছবিটি অভিনব।
চলচ্চিত্রে প্রথম প্রায়োগিক ভাষা গল্প নিয়ে হাজির হন মার্কিন নির্মাতা ডি. ডব্লিউ গ্রিফিথ। তাঁরর পরিচালিত Birth of a nation(১৯১৫) ছিল প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র। কিন্তু সিনেমাটি ছিলো একটা বর্ণবাদী চরিত্রের।এতে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবমাননার ও বর্ণবিদ্বেষী গোষ্ঠী '' কু- ক্ল্যাক্স- ক্যান(Ku Klax klann)দের মাঝে উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই ছবি প্রদর্শিত হওয়ার পর আমেরিকার বহু শহর ও প্রেক্ষাগৃহে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। John Howard Lawson তাঁর The creative proocess বইয়ে গ্রিফিথকে নিয়ে লেখেন- " He(Grifith) felt that the fate of huminity is a factor of history.... he couldn't believe that huminity would ever control its own destiny. His philosophic views were colored by the vulgariation of Darwin's theories current at the time... critics have praised the film's technical brilliance and deplored it's reactionary treatment of the Negro struggle for freedom. It's advance techniques and backward socialcial content often conosidered as fixed opposites."
এতেই বোঝা যায় কি ছিলো সেই সময়ে বুর্জোয়া চলচ্চিত্রের চেহারা!
১৯২৫ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি আইজেনস্টাইন পরিচালিত বিখ্যাত ছবি "Battleship potempkin"। ১৯০৫ সালে পটেমকিন জাহাজের নৌ-বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে এই সিনেমাকে ধরা হয় পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র  হিসেবে। পটেমকিন জাহাজের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় এবং তা দমন করা হয় নিষ্ঠুরভাবে।কিন্তু ব্যর্থতার ও থাকে বিজয়ের শিক্ষা। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে শ্রমিক-কৃষক-সিপাহী জনতাকে নিয়ে বলশেভিক পার্টি সেই ইতিহাস তৈরী করে। আইজেনস্টাইন দেখাচ্ছে- নিয়তির কাছে মানুষ হারতে পারে না।মানুষই হচ্ছে সেই নিয়তির নিয়ন্তা।এখানে নায়ক হলো জীবন।নায়ক হলো মানুষ।একা ও একজন নয়- অনেক ও অসংখ্য মানুষ। ১৯৫৮ সালে ব্রাসেলসে  "আর্ন্তজাতিক চলচ্চিত্র উৎসব"য়ে এই ছবিকে ''The best film of all times and peoples" এবং আইজেনস্টাইনকে সর্বকালের সেরা চিত্রপরিচালক হিসেবে  ভূষিত করা হয়।" অক্টোবর", "জেনারেল লাইন" তাঁর অন্যতম সেরা নির্মাণ।


EmoticonEmoticon