১৯৮৫ সালে দীলিপ রায়ের পরিচালিত একটি ছবি দেখেছিলাম। ছবিটি আমার মনে খুব দাগ কেটেছিলো। একটা অস্ফুট বেদনা অস্বস্তি হয়ে গলায় আটকে গিয়ে কষ্ট দিয়েছিলো।
নীলকণ্ঠ ছবিটির গল্পের সাথে আজকের রোহিঙ্গা নামের বিস্মৃত বাঙালীর ভাগ্য বিড়ম্বনার কোথায় যেনো একটা মিল আছে। আর, আমিও কেনো জানি কণ্ঠে সেই অস্বস্তিটা বোধ করি ওদের কথা ভেবে।
নীলকণ্ঠের ছবির কাহিনীতে ট্রেইনে যাত্রাকালে পরিবারের কাছ থেকে ছোট্টো বোনটি বিছিন্ন হয়ে গেলে, সে মেয়েধরাদের হাতে পড়ে। আর, সেই থেকে বড়ো ভাইটি তাকে খুঁজতে থাকে।
অনেক বছর ধরে খুঁজতে-খুঁজতে বড়ো ভাইটি ততোদিনে যুবতী হয়ে ওঠা সেই বোনটিকে আবিষ্কার করেন পতিতা হিসেবে। তার খুব কষ্ট হয়। তবুও হারানো সেই বোনটিকে এতো বছর পর ফিরে পেয়ে ভাইটি দারুণ এক প্রাপ্তিবোধে তাকে নিজেদের পৈত্রিক বাড়ীতে নিয়ে যান। কিন্তু হায়, তাঁরই অন্য ভাই-বোনেরা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।
বড়ো ভাইটি বিশ্বাস করতে পারেন না, একই রক্তের, একই মা-বাবার সন্তান হয়ে অন্যরা হতভাগ্য বোনটিকে গ্রহণ করতে পারছে না কেনো! পরিবার লোকদের এই ঘৃণা বড়ো ভাইটি শিবের কণ্ঠে ধারণ করা বিষের মতো ধারণ করে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেন আর পেছনে গীত হয় শচীনদেব বর্মনের কণ্ঠেঃ
"তোরা কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধনরে কইও নাইওর নিতো বইলা..."
আজ যারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত, তাদরেকেও কয়েক শতাব্দী আগে বাংলায় হানা দিয়ে আরাকানের মগ দস্যুরা ধরে নিয়ে গিয়ে দাস বানিয়েছিলো। বাঙালীর মধ্যে তখনও আজকের মতো বাঙালীবোধ গড়ে উঠেনি বলে তারা নিজেদেরকে বাঙালী হিসেবে জানে না। অথচ তারা নাফ নদীর ওপারে থেকে এবারের বাঙালীর মতো অভিন্ন ভাষায় কথা বলে।
ওরা নিজেরা নিজেদেরকে বাঙালী বলে জানে না; জানে রোহিঙ্গা বলে। কিন্তু যারা ওদের দাস বানিয়েছিলো বাংলা থেকে লুটে নিয়ে, তারা কিন্তু ওদেরকে বাঙালী নামে চিহ্নিত করেই ধর্ষণ করছে, উচ্ছেদ করছে, হত্যা করছে।
এই আত্মভোলা বাঙালীরা জীবন বাঁচাতে নাফ নদীর এপারে আত্মসচেতন 'স্বাধীন' বাঙালীর কাছে আসছে, কিন্তু ওরা তাদেরকে ভাই বলে, বোন বলে চিনতে পারছে না। হায়, বাঙালী!
ভাবতে আমার কষ্ট হয়। মগ দস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিত আমার রক্তের মানুষের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে গিয়ে আমি সেই নীলকণ্ঠ ছবি দেখার পর কণ্ঠে অনুভূত দলা পাকানো অস্ফূট বেদনাটা বারবার অনুভব করি। কোনোভাবে সরাতে পারি না। আমি ভাবি, আমিও কি সেই নীলকণ্ঠ?
০৯/০৯/২০১৭
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
EmoticonEmoticon