বিখ্যাত বিটলস ব্যান্ডের জন লেনন যখন স্কুলে পড়েন তখন স্কুল থেকে একবার একটা রচনা লিখতে দেওয়া হল ; প্রসঙ্গ- জীবনে কি হতে চাও ?
ক্লাসের সবাই স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট , প্রেসিডেন্ট এসব হতে চাওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে রচনা লিখে জমা দিলো । জন লেনন ওসবের কিছুই লিখলেন না , তিনি লিখলেন- আমি জীবনে সুখি হতে চাই ।
এই লেখা দেখে শিক্ষক তাকে ডেকে বললেন যে জন লেনন সম্ভবত রচনাটার মানেই বুঝতে পারেন নি । জবাবে জন লেনন শিক্ষককে বললেন- “ আপনি সম্ভবত জীবনের মানেই বুঝতে পারেন নি । “
জীবনকে দেখার তার নিজের চোখটা কেবলই নিজের চোখ বলে মনে হয়েছে। তিনি বলতেন,
'অল্প বয়সে সাফল্য জুটে গেছে বলে আমি বেঁচে গেছি। তারমানে বাদবাকি জীবনে সত্যি সত্যি যা আমি করতে চাই, তা-ই করতে পারি। শুধু সাফল্যের জন্য গোটা জীবন বরবাদ হয়ে যাওয়াটা সাংঘাতিক।'
জন লেনন যখন জন্ম নেন, অক্সফোর্ড ম্যাটারনিটি হাসপাতালের আশপাশ জুড়ে তখন চলছে জার্মান বিমান হামলা। আকাশ থেকে ক্রমাগত বোমাবর্ষণের মধ্যেই ১৯৪০ সালের ৯ অক্টোবর জন্ম হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা সংগীত তারকার।
তাই হয়ত ৭০-এর দশকের প্রথমার্ধে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন জন লেনন। তার গাওয়া ‘গিভ পিস আ চান্স’ ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হতে অগণিত মানুষকে উৎসাহ যোগায়। লেননের এই যুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় ক্ষুব্ধ হয় নিক্সন প্রশাসন। নানাভাবে হয়রানি করার পাশাপাশি তাকে জোর করে নিজ দেশ ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দীর্ঘ এক আইনি লড়াই শেষে মার্কিন সরকারের সব অপচেষ্টা বিফল করে দিয়ে ১৯৭৬ সালে যুক্ত্ররাষ্ট্রের গ্রীন কার্ড লাভ করেন লেনন।
৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিটলস হয়ে ওঠে পৃথিবীর জনপ্রিয়তম ইংলিশ রক ব্যান্ড। সে সময় জন লেননই ছিলেন ব্যান্ডটির ভোকাল।
ক্যারিয়ারের শীর্ষে থাকার সময় সুখ্যাতির সাথে সাথে নানা বিতর্কও ছিল লেননের নিত্যসঙ্গী। একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘জনপ্রিয়তায় বিটলস যীশু খ্রীস্টকেও ছাড়িয়ে গেছে’। সমালোচনার ঝড় ওঠে পশ্চিমা বিশ্বে। পরিস্থিতি সামাল দিতে লেনন বলেন, তিনি কোনো সম্প্রদায়কে আঘাত করতে এমন মন্তব্য করেননি, শুধুমাত্র বিটলসের খ্যাতির পরিধি বোঝাতে যীশু খ্রীস্টের উদাহরণ টেনেছেন মাত্র। কিন্তু তাতেও নেভানো যায়নি ক্ষোভের আগুন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে লেনন আর বিটলসকে নিষিদ্ধ করা হয়। লেননের গানের রেকর্ড কিনে জনসমক্ষে পোড়ানো নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। তবে এ নিয়েও জন লেনন রসিকতা করতে ছাড়েননি। বলেন, ‘অন্তত পোড়ানোর জন্য হলেও, তারা আমার রেকর্ড কিনছে।’
"কল্পনা করো কোনো স্বর্গ-নরক নেই, উপরে শুধু মুক্ত আকাশ।রাষ্ট্রের নামে কোনো ভৌগলিক সীমা রেখা নেই, কাউকে হত্যা করা বা নিজের প্রাণ দেওয়ার কোনো কারণ নেই, ধর্মের নামে মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। নেই কোনো মিছিল, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, লোভ নেই। মানুষে-মানুষে এক পরম ভ্রাতৃত্বে এই পুরো পৃথিবীতে এক হয়ে এক অপূর্ব প্রশান্তিতে বাস করছে। ধর্ম, রাষ্ট্র, ভেদাভেদহীন পুরো পৃথিবীই একটা গ্রাম, কেবল মানুষের গ্রাম।"
তোমরা আমাকে স্বপ্নবাজ বলতে পারো, কিন্তু বিশ্বাস করো এই দলে আমি একা নই, একদিন তোমরাও এই দলে যোগ দিবে এই আমার প্রত্যাশা।'
তাঁর গাওয়া ইমাজিন গানটি মুক্তিকামী মানুষের থিম সংগীত বললে ভুল হবে না।রক মিউজিকের ইতিহাস ‘দ্য বিটলস’ ছাড়া লেখা হবে না। তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে একসময় রাজত্ব করে গেছে বিশ্বখ্যাত এই ব্যান্ডদলটি।
গিটার হাতে যারা পৃথিবীতে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে গানকে হাতিয়ার করে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর সঙ্গীতকে নিয়ে গেছেন মানবিকতার ভিন্নমাত্রায়, তাদেরই একজন জন লেনন। যার স্ব্বপ্ন ছিল যুদ্ধহীন, বর্ণহীন, বৈষম্যহীন এক সুন্দর পৃথিবীর। এই যৌক্তিক বিশ্বাসই একদিন লেননের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছিল।
এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড মানা হয় বিটলস কে। সেই বিটলসের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। মানব ধর্মে বিশ্বাসী লেনন ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। মাত্র ৪০ বছর বয়সে, ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর বিটলস সংগীতগোষ্ঠীর এক অন্ধ ভক্তের গুলিতে নিহত হন লেনন। মৃত্যুকালীন তার শেষ কথা ছিল অভিযোগ এবং দাবির মতো, ‘আমাকে গুলি করা হয়েছে... এমন ভালোবাসা কার দরকার?’
জন লেনন। প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তিনি শিল্পে, তার গানে মুক্তিকামী এক স্বপ্নের বীজ রোপণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর অবতারনা করতেন সেই অন্তিম মায়ামুগ্ধতা যা অদেখা দুনিয়ার প্রতিক।
জন লেনন.. অশ্লীল তছনছের ভেতর, তুরীয় উদ্বেগের ভেতর তিনি একটা মুক্ত দুনিয়া, গোঙানি থেকে বেরিয়ে আসা ভালবাসার কথা বলেছিলেন.. ঘাতকের গুলি আজকের দিনে থামিয়ে দিয়েছিল অলৌকিক আনন্দময় গান, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত গিটার.. অন্ধকার গ্রহে আজও গান বুকে করে হেঁটে যাওয়ার জন্য তিনিই শ্রেষ্ঠতম ইস্তাহার..
আজন্ম প্রেমিক জন লেনন স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সাথে
EmoticonEmoticon