জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, খুলনায় নানার বাড়িতে। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ মাহবুবুল হক এবং মায়ের নাম রওশন হাসিনা। ''“আমার মা মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের দলে কাজ করেছেন। তার মুখে শুনে প্রীতিলতাকে আমি ছোটবেলা থেকেই অনুভব করে আসছি''।
তাঁর বাবার নাম সৈয়দ মাহবুবুল হক, যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক ছিলেন, প্রচুর পড়াশুনা করা লোক ছিলেন, অনেকগুলি ভাষাও জানতেন, বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, উর্দু, হিন্দী, ফারসি, সংস্কৃত ও আরবী, এবংবা ভাষায় তিনি গল্প বলতে পারতেন, কবিতা আবৃতি করতে জানতেন, কথা বলতে পারতেন ।
১১ সন্তানের মধ্যে প্রিয়ভাষিণী সবার বড়। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম কংগ্রেস করতেন। ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্টের শাসনকালে স্পিকার হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে তার নানা সুপ্রিম কোর্টে কাজ করার জন্য ঢাকা চলে আসেন। প্রিয়ভাষিণীও নানার পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। ভর্তি হন টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে। পরবর্তীতে নানা মিন্টু রোডের বাসায় চলে এলে প্রিয়ভাষিণী ভর্তি হন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। তিনি ইউএনডিপি, ইউএনআইসিইএফ, এফএও, কানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। শেষ বয়সে এসে নানা শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন ।
দামী জিনিসের পরিবর্তে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে কিভাবে ঘর সাজানো যায় তার সন্ধান করা থেকেই তাঁর শিল্পচর্চার শুরু। নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিভাবে অল্প খরচে সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে সে বিষয়গুলো তিনি দেখিয়েছেন। ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের গুড়ি দিয়েই মূলত তিনি গৃহের নানা শিল্প কর্মে তৈরি করতেন।
একাত্তরে তিন ছেলের মা প্রিয়দর্শিনীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তারপর মুক্তির জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপ দেয় বাংলাদেশ, মানুষ আহুতি দেয় জীবন ও সম্ভ্রম, কেউ দু ই, একাত্তরের দুঃসহ অন্ধকারের চাদর যখন তার জীবনকে মুড়িয়ে ফেলেছিলো, যুদ্ধ শেষে কেউ ছিলোনা তার পাশে, না স্বদেশ না স্বজন, উনিশ শ বাহাত্তরে তিন ছেলে সমেত তাকে বিয়ে করে করেন রাজঘাট যশোরের পাটকলের লেবার অফিসার আহসানউল্লাহ আহমেদ, এই দুজন সাহসী মানুষ নিজেদের খুঁজে পেয়েছিলেন,ব্যক্তিজীবনে দুজনে খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন ।
সবসময় কপালে বড় একটি গোল টিপ, কখনো আবার কপালে সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য্য, দেশকে ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেন তথাকথিত রক্ষণশীল ও মৌলবাদীদের সমালোচনা ভ্রূকুটির তোয়াক্কা না করে !
বসুন্ধরা পূর্বাচলে তার বাসা । মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেক পরে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, সেটা ২০১৬ সালে, মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে ২১ জুলাই গেজেট জারি করেছিলেন সরকার। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. মাহবুবুর রহমান ফারুকী এতে স্বাক্ষর করেন। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৩৫তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রিয়ভাষিনীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জানা গেছে তিনি মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাননি ।
২০১৭ সালের ৮ ই নভেম্বর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী বাথরুমে পড়ে গিয়ে পায়ে গোড়ালিতে ব্যাথা পেয়েছিলেন। পরে পায়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়, এছাড়া শিল্পী ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, হৃদরোগসহ বেশ কয়েকটি অসুখে নানা জটিলতায় ভুগেছেন । এ অবস্থায় তার মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে। ।তার আরও উন্নত চিকিৎসা তার দরকার ছিল । দেশে সম্ভবপর চিকিৎসা করিয়েছেন তাঁর ছেলে মেয়েরাই । সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেকেরই তাকে দেখতে যাওয়া উচিত ছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর ব্যাপারে সরকারের উচ্চমহল থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
মুক্ত মানসিকতার চর্চার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, মুক্তমন ও প্রগতিশীল মানুষদের হত্যার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার, ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধেও দৃঢ় অবস্থান ছিল তাঁর, যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে জনমত তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে একাত্তরের এই সম্ভ্রম আহুতি দেয়া মুক্তিযোদ্ধার, যিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সক্রিয় থেকেছেন । বিভিন্ন সময়ে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল ।
যুদ্ধশেষে শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ষিতা নারীদের সমাজে পুনর্বাসনের জন্য কীভাবে তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করেন সে কথা শুনিয়েছেন ডা. জিওফ্রি ডেভিস। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবে কাজে লাগেনি। পকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতন ও গর্ভধারণের পর স্বাধীন দেশের ওই নারীরা সমাজের চোখে পুরোপুরি অস্পৃশ্য হয়ে যান।
বাংলাদেশে গণহত্যার বিচার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গণহত্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হেলেন জারভিস বলেছিলেন , ''যুদ্ধের বিশেষ অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণকে পদ্ধতিমূলকভাবে ব্যবহার করার ঘটনা বিশ্বে প্রথম।
“২৬ মার্চ ১৯৭১,বিভিন্ন স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ধরে আনা হয়।আসা মাত্রই সৈনিকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে।তারা ব্যারাকে ঢুকে প্রতিটি যুবতী,মহিলা এবং বালিকার পরনের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে ধর্ষণে লিপ্ত হতে থাকে।রাবেয়া খাতুন নামক একজন ছিল ঐ স্থানে কমরত সুইপার । ড্রেন পরিস্কার করতে করতে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।পাকসেনারা ধর্ষন করেই থেকে থাকেনি,সেই মেয়েদের বুকের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দেয়,মাংস তুলে নেয়।
মেয়েদের গাল,পেট,ঘাড়,বুক,পিঠ ও কোমরের অংশ তাদের কামড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে প্রতিদিন।যেসব মেয়েরা প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করত তাদের স্তন ছিড়ে ফেলা হত,যোনি ও গুহ্যদ্বা্রের মধ্যে বন্দুকের নল,বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢূকিয়ে হত্যা করা হত।বহু অল্প বয়স্ক বালিকা উপুর্যুপুরি ধর্ষণে নিহত হয়।এর পরে লাশগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দেয়া হত।হেড কোয়ার্টারের দুই,তিন এবং চারতলায় এই্ মেয়েদের রাখা হত,মোটা রডের সাথে চুল বেঁধে।এইসব ঝুলন্ত মেয়েদের কোমরে ব্যাটন দিয়ে আঘাত করা হত প্রায় নিয়মিত,কারো কারো স্তন কেটে নেয়া হত,হাসতে হাসতে যোনিপথে ঢুকিয়ে দেওয়া হত লাঠি এবং রাইফেলের নল।
কোন কোন সৈনিক উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ মেয়েদের বুকে দাঁত লাগিয়ে মাংস ছিড়ে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ত,কোন মেয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তখনই হত্যা করা হত।কোন কোন মেয়ের সামনের দাঁত ছিল না,ঠোঁটের দু’দিকের মাংস কামড়ে ছিড়ে নেয়া হয়েছিল,প্রতিটি মেয়ের হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে থেতলে গিয়েছিল লাঠি আর রডের পিটুনিতে।কোন অবস্থাতেই তাঁদের হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হত না,অনেকেই মারা গেছে ঝুলন্ত অবস্থায়।“
২৭ মার্চ,১৯৭১,ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর থেকে লাশ ট্রাকে তুলতে গিয়ে একটি চাদর ঢাকা ষোড়শী মেয়ের লাশ দেখতে পান পরদেশী।সম্পূর্ণ উলঙ্গ লাশটির বুক এবং যোনিপথ ছিল ক্ষত বিক্ষত,নিতম্ব থেকে টুকরো টুকরো মাংস কেটে নেয়া হয়েছিল।
২৯ মার্চ শাখারীবাজারে লাশ তুলতে গিয়ে পরদেশী সেখানকার প্রায় প্রতিটি ঘরে নারী,পুরুষ,আবাল বৃদ্ধ বনিতার লাশ দেখতে পান,লাশগুলি পচা এবং বিকৃত ছিল।বেশিরভাগ মেয়ের লাশ ছিল উলঙ্গ,কয়েকটি যুবতীর বুক থেকে স্তন খামচে,খুবলে তুলে নেয়া হয়েছে,কয়েকটি লাশের যোনিপথে লাঠি ঢোকান ছিল।মিল ব্যারাকের ঘাটে ৬ জন মেয়ের লাশ পান তিনি,এদের প্রত্যেকের চোখ,হাত,পা শক্ত করে বাঁধা ছিল,যোনিপথ রক্তাক্ত এবং শরীর গুলিতে ঝাঝরা ছিল।
ঢাকা পৌরসভার সুইপার সাহেব আলীর ভাষ্যে ২৯ মার্চ তার দল একমাত্র মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে কয়েক ট্রাক লাশ উদ্ধার করে।তিনি আরমানীটোলার এক বাড়িতে দশ এগারো বছরের একটি মেয়ের লাশ দেখতে পান,সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত,জমাট বাঁধা ছোপ ছোপ রক্ত সারা গায়ে,এবং তার দেহের বিভিন্ন স্থানের মাংস তুলে ফেলা হয়েছিল।ধর্ষণ শেষে মেয়েটির দুই পা দু’দিক থেকে টেনে ধরে নাভি পর্যন্ত ছিড়ে ফেলা হয়েছিল (ডোম পরদেশীর বর্ণনা )
৭১ এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে পাকবাহিনীর একটি বিরাট ক্যাম্পে পরিণত করা হয়।এখানে বন্দী ছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্রী মঞ্জিলা এবং তার দুই বোন মেহের বানু এবং দিলরুবা।।তাদেরকে আরো ৩০ জন মেয়ের সাথে একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়,সার্বক্ষণিক প্রহরায় থাকতো দুজন সশস্ত্র গার্ড।এই মেয়েগুলোকে ওই ক্যাম্পের সামরিক অফিসারদের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করা হত।প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হত ৫/৬ জন মেয়েকে,এবং ভোরবেলা ফিরিয়ে দেয়া হত অর্ধমৃত অবস্থায়।প্রতিবাদ করলেই প্রহার করা হত পূর্বোক্ত কায়দায়।একবার একটি মেয়ে একজন সৈনিকের হাতে আঁচড়ে দিলে তখনই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
কুমারখালির বাটিয়ামারা গ্রামের মোঃ নুরুল ইসলামের বর্ণনায় একটি আপাত-অদ্ভুত ঘটনা জানা যায়।ঐ এলাকার একজন রাজাকারকে একদিন দুজন পাকসেনা মেয়ে যোগাড় করে দিতে বললে সে তাদেরকে তার বাড়ি নিয়ে যায়,খবর পেয়ে বাড়ির সব মেয়ে পালিয়ে গেলেও তার বৃদ্ধা মা বাড়িতে থেকে যান।সৈনিক দু’জন রাজাকারটির বুকে রাইফেল ঠেকিয়ে পালাক্রমে তার মাকে ধর্ষণ করে।এর পরে রাজাকারটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
দেশে ফেরার পর এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ' দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে তাদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবেনা। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে, যথারীতি সন্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশ্যে বলছি যে আপনারাও ধন্য। কেননা এমন ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা কন্যার পিতা হয়েছেন। '
কিন্তু যুদ্ধ আমাদের ভূখণ্ড দিয়েছে, আমাদের রক্ষণশীল, বদ্ধ অন্ধ সংস্কার পূর্ণ মন মানসিকতা পাল্টাতে পারেনি, এখনো আমরা একজন ধর্ষিতাকে বাঁকা চোখে দেখি, মন থেকে তাদের গ্রহণ করতে পারিনা, তাদেরকে নিজের পরিবারে ঠাঁই দেয়ার চিন্তা তো দূরের কথা, ধর্ষণকারীকে ঘৃণা করতে জানে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে চায় আঙুলে গোনা কিছু মানুষ !
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম আহুতি দেয়া ধর্ষিতা নারীদের স্বাধীন দেশে, সমাজে ও পরিবারে দেখা হতো অসন্মানের চোখে। নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত পরিবারভুক্ত অধিকাংশ নারী তলিয়ে গেছেন আত্মমর্যাদার অভাবে, শিকার হয়েছেন ধর্মান্ধতার-অশিক্ষা-কুশিক্ষার-অপমানিত জীবন-জীবিকার অনলে, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে থাকা নির্যাতিতা নারীরা বিগত চার যুগ ধরে তাদের জীবন কাটিয়ে এখন অধিকাংশই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। সারা জীবন ধরে লাঞ্ছণা-গঞ্জনা সয়ে সমাজচ্যুত হয়ে অনাহারে থেকে জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। অনেকেই সমাজের চোখে যা পাপ, তা গোপন করে টিকে থেকেছেন বেঁচে থাকার সাথে সন্ধি করে, যেন কত না সীমাহীন পাপ তারা করেছিলেন ।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ ও গণধর্ষণকে গণহত্যার শামিল বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল নির্যাতিতা নারীদের জন্য অনুপ্রেরনার নাম ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী, সমস্ত অলিখিত ট্যাবু ভেঙে শিক্ষিত সমাজে সাহসী বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে এমন নামটি একটিই । ১৯৯৯ সালে প্রথম জনসমক্ষে আসা বীরাঙ্গনা নারী হলেন মানবাধিকার কর্মী ভাস্কর্য শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী। তিনি বলেছিলেন, ''যুদ্ধের শিকার হয়েছে যে নারী তার তো নিজের কোনো লজ্জা নেই''। তিনি আশা করেছিলেন; তার দেখা-দেখি হয়তো অনেকেই মুখ খুলবেন কিন্তু তিনি তেমন কাউকে পাশে পাননি।
একাত্তরের সেই ভয়াবহ ধর্ষণ সম্পর্কে একমাত্র জবানবন্দী -দানকারী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার সাক্ষাৎকারে জানান, “রাতে ফিদাইর (উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা) চিঠি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুলতান, লে. কোরবান আর বেঙ্গল ট্রেডার্সও অবাঙালি মালিক ইউসুফ এরা আমাকে যশোরে নিয়ে যায় । যাওয়ার পথে গাড়ির ভেতরে তারা আমাকে ধর্ষণ করে। নির্মম, নৃশংস নির্যাতনের পর এক পর্যায়ে আমার বোধশক্তি লোপ পায়। ২৮ ঘণ্টা চেতনাহীন ছিলাম”। (একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির)
''আমি উর্দুতে একবার ইংরেজিতে একবার বলছিলাম প্লিজ আমাকে হত্যা কর। আমাকে রেপ কর তবে আমাকে হত্যা কর। তবু আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে যেও না। তারপরেও ক্যান্টনমেন্টে তারা আমাকে নিয়ে গেল''।
স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন ''আমার মাও একজন প্রগতিশীল মহিলা ছিলেন। বলা চলে তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কারণ তিনি ছোট্ট আকারে একটা হোম খুলে ছিলেন । মুক্তিযোদ্ধা দের খাবারের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। আমার মা আর তার বান্ধবী মিলে যশোরের রেল রোডে একটা বাড়িতে চিলে কোঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাস্তা দিতেন। তিনি তার ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আমার ভাই শিবলি কোন দিন বিয়ে করেনি সেও পূর্ণদমে মুক্তিযুদ্ধ যোগ দিল টেলিফোনে চাকরি করাকালীন ।
তখন একটা সুবিধা ছিল অনেক কমুনিকেশন তার ছিল। ফলে সে অনেক খবর আনতে পারবে । ডিনামাইড আনা ও এগুলোতে লিড দেওয়ার মধ্যে আমার ভাই শিবলী একজন ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্টেও তার নাম আছে। যুদ্ধের বিষয়ে তারা ঠিক ছিল কিন্তু আমার বিষয়ে তারা একটু নড়ে গিয়েছিল যে,আমাকে বাসায় গ্রহণ করা যাবে না। খুব অবাধে বাড়িতে যেতে পারিনি আসলে। আমার নিজের মধ্যেও সংকোচ ছিল যে, আসলে আমি বিশাল কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কারো সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না যদিও আমার মা কোন কালেই এসব নিয়ে প্রশ্ন করেননি''।
''অপরিণত বয়সে যে বিষয়টি আমি সবার কাছ থেকে লুকাতে চেয়েছিলাম; ভাবতাম আমার ছোঁয়া লাগলে সব কিছু অপবিত্র হয়ে যাবে। এই সমাজ আমাকে আঙুল তুলে কথা বলছে আর আমি সেই অপমান গুলো সহ্য করছি। আমার মনে হয় আমার সেই দিনের অপমান-ই আমাকে অনুপ্রাণিত করছে।''
''মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে সমাজ অনেক ভাবে তাদের নিগৃহীত হতে হয়েছিল। বলা চলে তাদেরকে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে হয়েছিল। সমাজ পরিবার তাদের গ্রহণ করে নি। অনেকে গ্রহণ না করার জন্য হিন্দু থেকে মুসলিম হয়ে বিয়ে করেছিলেন। তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও বীরাঙ্গনাদের বিয়ে করেন''।
সুসান ব্রাউনি মিলার তার গ্রন্থের ৮৩ পাতায় উল্লেখ করেছেন, কোন কোন মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এক একটি গণ-ধর্ষণে ৮/১০ থেকে শুরু করে ১০০ জন পাকসেনাও অংশ নিয়েছে।
অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস উনি যখন রেড ক্রস থেকে বাংলাদেশের হাসপাতালে এসেছিলেন একাত্তরের পরবর্তী বীরাঙ্গনাদের সহায়তা দেবার জন্য। দেশজুড়ে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় চালানো নমুনা জরিপের মাধ্যমে পরিসংখ্যান তৈরি করে জানান, ৪ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার নারী মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
তিনি আরো জানান, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই ২ লাখ।১৯৭২ সালে মার্চ থেকে ছয় মাস বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসক ড. জেফ্রি ডেভিস। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান- “ধনী ও সুন্দরী মেয়েদেরকে অফিসারদের জন্য রেখে দেয়া হতো আর বাকিদের অন্যান্য সাধারন সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো। আর মেয়েদেরকে দারুণ কষ্টে ফেলে দেয়া হতো। তাদেরকে পর্যাপ্ত খেতে দেয়া হতো না। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের চিকিৎসা দেয়া হতো না। অনেকেই ক্যাম্পের মধ্যে মারা গেছে।”
আবার এসেছে সেই মার্চ, নৃশংস পাকিস্তানী জানোয়ারদের বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাস, প্রতিরোধ আর স্বাধীনতার মাস, এই মাসেই বিদায় নিলেন প্রজন্মের কাছে স্পষ্টবাদিতা ও সাহসিকতার নিদর্শক, আমাদের একজন পরম শ্রদ্ধেয় মা কিন্তু যতদিন এই বাংলাদেশ থাকবে তাদের আদতে কোনো মৃত্যু নেই ।
EmoticonEmoticon