বুধবার, ১৬ মে, ২০১৮

ইতিহাস কথা কয়, ইতিহাসকে কথা বলতে দাও

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের বেশ কিছু বিবরণ নথিবদ্ধ করা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্যাতনের শিকারদের জবানিতে ।

নির্যাতনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈন্যরা গ্রহণ করত তা হচ্ছে-১. অশ্লীল ভাষায় গালাগালি, সেই সঙ্গে চামড়া ফেটে রক্ত না বেরুনো পর্যন্ত শারীরিক প্রহার ২. পায়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রহার ৩. উলঙ্গ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উন্মুক্ত স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা ৪. সিগারেটের আগুন দিয়ে সারা শরীরে ছ্যাঁকা দেওয়া ৫. হাত ও পায়ের নখ এবং মাথার ভেতরে মোটা সুচ ঢুকিয়ে দেওয়া

৬. মলদ্বারের ভেতরে সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া, বরফ খণ্ড ঢুকিয়ে দেওয়া ৭. চিমটি দিয়ে হাত ও পায়ের নখ উপড়ে ফেলা ৮. দড়িতে পা বেঁধে ঝুলিয়ে মাথা গরম পানিতে বার বার ডোবানো ৯. হাত-পা বেঁধে বস্তায় পুরে উত্তপ্ত রোদে ফেলে রাখা ১০. রক্তাক্ত ক্ষতে লবণ ও মরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে দেওয়া ১১. নগ্ন ক্ষতবিক্ষত শরীর বরফের স্লাবের ওপর ফেলে রাখা ১২. মলদ্বারে লোহার রড ঢুকিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া ১৩. পানি চাইলে মুখে প্রস্রাব করে দেওয়া ১৪. অন্ধকার ঘরে দিনের পর দিন চোখের ওপর তীব্র আলোর বাল্ব জ্বালিয়ে রেখে ঘুমোতে না দেওয়া ১৫. শরীরের স্পর্শকাতর অংশে বৈদ্যুতিক শক প্রয়োগ প্রভৃতি।

অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার জিওফ্রে ডেভিস র মন্তব্যে পাওয়া যায়, তারা তাদের পদাতিক বাহিনীকে পেছনে রেখে গোলন্দাজ বাহিনীকে সামনে নিয়ে আসত। তারপর হাসপাতাল, স্কুল-কলেজে গোলা ছুড়ে গুড়িয়ে দিত। এরফলে শহরে নেমে আসত চরম বিশৃঙ্খলা আর তারপর পদাতিক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে মেয়েদের বেছে বেছে আলাদা করত। শিশু ছাড়া যৌনভাবে ম্যাচিওরড সকল মেয়েকে তারা একত্রে জড়ো করত। আর শহরের বাকি লোকজনকে বন্দী করে ফেলত পদাতিক বাহিনীর অন্যরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো। আর তারপর মেয়েদের পাহারা দিয়ে কম্পাউন্ডে নিয়ে এসে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হতো। অত্যন্ত জঘন্য একটা ব্যাপার ছিল এটা। বিশ্বের কোথাও কখনও এমন ঘটনার নজির পাওয়া যায় না। তবুও, এমনটাই ঘটেছিল।’

'পূর্বতন সিলেটে ৩০ হাজার বীরাঙ্গনার সন্ধান । এ অঞ্চলের চা বাগানগুলোর মহিলা শ্রমিক, তাদের যুবতী ও কিশোরী কন্যাগণ, মনিপুরী ও খাসিয়া মহিলারা ব্যাপক হারে নির্যাতনের শিকার হন। সিলেট শহর, বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা, আদিত্যপুর, শ্রী রামসী, শেরপুর, পীরপুর, পীরনগর, করিমগঞ্জ সীমান্ত ও হাওড় এলাকা, সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকা, মৌলভীবাজার শহর, রাজনগর, সাধুহাটি, কমলগঞ্জ থানার শমসের নগর, মনিপুরীদের বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জসহ বিভিন্ন থানার গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে পাকিরা অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে।

এ ছাড়া টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থানার ছাব্বিশাসহ বিভিন্ন গ্রাম, বরিশালের গৌরনদী থানার প্রায় সব গ্রাম, আগৈলঝাড়ার রাজিহার, চেতনার কোলা গ্রামসহ সমগ্র বরিশালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ব্যাপক নির্যাতন চালায়।’

“রাজাকাররা তাদের কর্মকাণ্ড এখন হত্যা ও চাঁদাবাজিতেই আটকে রাখেনি, এখন তারা বেশ্যালয়ও খুলেছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা একটি শিবির খুলেছে যেখানে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েদের আটকে রাখা হয়েছে, রাতে পাকবাহিনীর অফিসারদের সরবরাহ করা হয় তাদের। এছাড়াও প্রতিদিনই অনেক মেয়ে অপহরণ করছে তারা নিজেদের জন্যও, এদের অনেকেই আর ফিরে আসেনি…”
-সানডে টাইমসঃ ২০ জুন ১৯৭১

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য মতে, ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও বন্দি নির্যাতিতের সংখ্যা ৪ লাখ ৬৮ হাজার। অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা ১ লাখ ৮ হাজার। নির্যাতিত নারীর মধ্যে ৫৬.৫০ শতাংশ ছিলেন মুসলিম, হিন্দু ৪১.৪৪ এবং খ্রিস্টান ও অন্যান্য ২.০৬ শতাংশ। গবেষণায় স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের হার ৭০ শতাংশ এবং ক্যাম্পে রেখে নির্যাতনের ১৮ শতাংশ বলা হয়েছে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের  বিজয় কাহিনী যেভাবে মানুষের কাছে উঠে এসেছে তার সামান্য খন্ড হিসাবেও সমগ্র দেশের  নারী পুরুষের ওপরে পাশবিক নির্জনের ধরণ ধারণ উঠে আসেনি ,পুরুষের চাইতে হাজার গুন্ বেশি নারীর ওপরে নৃশংস নির্যাতনের ব্যাপকতা সেভাবে বিভাগ - জেলাওয়ারি - থানা পর্যায়ের ভিত্তিতে  কিছুই আসেনি ।

একাত্তর সালে পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর তাবৎ অসুস্থ অত্যাচারীদের হার মানিয়েছিল, পাকিস্তানী সৈনিক ও অফিসাররা নারী ধর্ষণ করেই থেমে থাকেনি, ধর্ষণের পরে পায়ুপথ ও যোনিপথে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে এহেন নৃশংস ত্যাচার চালায় যে এই নারীদের অনেকেরই প্রজনন ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর সালের  একমাত্র ঘটনা নয়, মুক্তিযুদ্ধে  এদেশের মানুষের  সত্তা যেমন আক্রান্ত হয়েছিল তেমনি নারীসত্তাকে দলিত ও ধ্বংস করাটাও লক্ষ্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধে নারী আক্রান্ত হয়েছিলেন, যোদ্ধা হিসাবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী হিসাবে, মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ না পেয়ে পরাজয়ের গ্লানি  মেটানোর লক্ষ্যবস্তু হিসাবে,  মা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্মদাত্রী হিসাবে ।

নিউজ উইকের সাংবাদিক টনি ক্লিফটন উল্লেখ করেছেন, ‘আমি দেখতে পাই যে, আক্ষরিক অর্থে মানুষ বোবা হয়ে গেছে, যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের চোখের সামনে বাচ্চাদের হত্যা করেছে এবং মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে তাদের ভয়ঙ্কর যৌন পরিতৃপ্তির জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে শত শত মাইলাই এবং লেডিসির মতো নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে আমার কোনই সন্দেহ নেই।’

নিউজউইকের সিনিয়র সম্পাদক এ্যারমাউড ডি ব্রোচ গ্রেভ : ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক বিদ্রোহীদের খুঁজতে আসার ভান করে ডেমরা গ্রাম ঘেরাও করে। তারপর ১২ থকে ৩৫ বছর বয়সী সকল নারীকে ধর্ষণ করে এবং ১২ বছরের বেশি বয়সী সকল পুরুষকে হত্যা করে।’

নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি এইচ, শ্যেনবার্গ জানিয়েছিলেন  : ‘পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই বাঙালী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে আটক রেখেছে। সৈন্যদের ব্যাংকারগুলিতে এসব মেয়েকে সারাক্ষণই নগ্ন অবস্থায় রাখা হতো। ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণের পর এসব নারীর অধিকাংশেরই ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।’

জন হেস্টিংস নামে এক মিশনারি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী সৈন্যরা… মেয়েদের যোনিপথে বেয়নেট ঢুকিয়ে তাদের হত্যা করেছে।’ মেয়েদের মসজিদে আটকে রেখেও ধর্ষণ করা হয়েছে। সাতক্ষীরার একটি গ্রামের মসজিদ থেকে বেশ কিছু নগ্ন নারী উদ্ধারের পর এ ধরনের ঘটনা নজরে আসে।

সিলেট শহরে মূলত পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে শালুটিকরে অবস্থিত সিলেট এয়ারপোর্ট এবং রেসিডেন্সিয়াল কলেজেই (সিলেট ক্যাডেট কলেজ)। অনেকের মতে শুধুমাত্র শালুটিকরেই তিনশত লোকের ওপরে হত্যা করা হয়। সেখানকার নদী ঘাটটির নাম হয়ে গিয়েছিল ‘করাচি বন্দর’। নরহত্যার পাশাপাশি এই ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে নারী নির্যাতনের প্রধান কেন্দ্রও। সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে প্রকাশ, শালুটিকরে অবস্থিত এই ক্যাম্পগুলোতে পাকিস্তানি হেরেমের ছবিগুলো এখনো পাকিস্তানিদের বিকৃত রুচির পরিচয় বহন করে।

১৯৭১-এ মুজিবনগর থেকে অনেকগুলো পত্রিকা বের হতো। এই পত্রিকাগুলোতেও মেলে শালুটিকরে নারী ধর্ষণের ব্যাপকতার সাক্ষ্য। ‘সাপ্তাহিক বাংলা’র ১৬ সেপ্টেম্বর ইস্যুতে ‘আম্বরখানা কলোনী ও মডেল স্কুলে ৫ শতাধিক বাঙালী মেয়ে বন্দিনী’  শিরোনামে প্রকাশিত খবরেও স্পষ্ট পাওয়া যায় নারী নির্যাতনের দলিল।

“পাঁচ শতাধিক বাঙালী মেয়ে আজও সিলেট শহরের আম্বরখানা কলোনী ও শালুটিকর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে বন্দিনী হয়ে আছে। পাক সেনাদের সীমাহীন অত্যাচারে দুঃসহ তাদের জীবন। কিন্তু মরার কোন উপায় নেই। পরণের শাড়ীগুলি পর্যন্ত পশুরা ছিনিয়ে নিয়েছে। গলায় দড়ি দেবার পর্যন্ত উপায় নেই। পরণে সামান্য একটা জাইঙ্গা আর ব্রেসিয়ার।

অর্ধনগ্ন এই সব মেয়েদের উপর রোজই চলে পাশবিক বলাৎকার। দানবের পৌনঃপুনিক ধর্ষণে ওরা বিধ্বস্ত। দস্যুরা বস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নিয়তই লুঠে নিচ্ছে ওদের মান সম্ভ্রম–কুমারীত্ব আর সতীত্বকে। বুকফাটা কান্না চার দেয়ালে বাধা পেয়ে ওদের কাছেই আবার ফিরে আসে। কে জানে তাদের মুক্তিকামী ভাই আর সন্তানেরা কবে তাদেরকে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে”। 

“শহরে পাক আর্মির প্রধান ঘাঁটি মডেল স্কুল, ক্যাডেট কলেজ প্রভৃতি জায়গায় আমরা অনুসন্ধানে গিয়েছি। আর্মির এই ঘাঁটি এবং ক্যাম্পগুলোতে আমরা গণহত্যার ও নারী নির্যাতনের আলামত পেয়েছিলাম। ক্যাম্পের একটা দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা সেই বাক্যটি এখনও আমার চোখে ভাসে – “আমি আর বাঁচতে চাই না”। বিভিন্ন আলামত দেখে আমার মনে হয়েছে, মণিপুরী সম্প্রদায়ের মেয়েদেরই বেশী নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা সেখানে মণিপুরী মেয়েদের প্রচুর স্কার্ট, টপস ও অন্যান্য পোশাক পড়ে থাকতে দেখেছি''। …

বালাগঞ্জের ইলাশপুর, কৈলাশপুর, শেরপুর, বুরুঙ্গা ও আদিত্যপুরে প্রতিটা জায়গায় নিরীহ মানুষদের হত্যা করার পর নারীদের ওপর পাকিরা শুরু করে তাদের বর্বরতা। রাজাকার সাদ মিয়ার সহযোগীতায় মাত্র আঠারো দিনের ব্যবধানে বুরুঙ্গাতে ৭৮ জন ও আদিত্যপুরে ৬৩ জন কে হত্যা করা হয়।

আদিত্যপুর গ্রামে গণহত্যা স্পটে তিনটি গুলি লাগা সত্ত্বেও বেঁচে যাওয়া শিবপ্রসাদ সেন চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের প্রথমে যে ঘরে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে আমি মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনেছি। বিভিন্ন নারী কন্ঠের চিৎকার শুনে মনে হয়েছে এখানে বহু নারীকে তারা নির্যাতন করেছে। এসব নির্যাতিত মেয়েদের মধ্যে এই গ্রামের সতীশের মেয়েরাও ছিল”।

স্বাধীনতার পর সুনামগঞ্জ পিটিআই-এর সম্মুখ প্রান্তরে যে বধ্যভূমির সন্ধান মিলে সেখানে শতাধিক কঙ্কাল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল বৃদ্ধ, যুবক, তরুণী ও যুবতীর লাশ। ক্যম্পের মধ্যেও পাওয়া যায় বিবস্ত্র অনেক মা-বোনের নিষ্প্রাণ দেহ।

সুনামগঞ্জের জয়কলস গ্রামের রাজাকার সাত্তার পুরো একাত্তর জুড়েই পাকিদেরকে প্রতিদিন একজন করে নারী সরবরাহ করত। তারা সে কাজকে বলত ‘খাসির চালান”। জামালগঞ্জ থানার পিস কমিটির সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ ওরফে লাল মিয়ার একটা নিজস্ব প্রমোদতরী ছিল, নাম “ঝুনু এক্সপ্রেস”। এই তরী ব্যবহার করা হত পাকিদের লালসা নিবৃত্তির লক্ষ্যে। এর পর সে নারীদেরকে ভাসিয়ে দেয়া হত সুরমার পানিতে।

পাকিস্তানিরা বিয়ানীবাজারে ১৭ জন দালালের সমন্বয়ে গঠন করে মজলিশে শুরা, আবার সেই সদস্যদের আলাদা আলাদা দায়িত্ব ছিল। তবে এই ১৭ জনের মধ্যে পাকিস্তানীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল আবদুল হক ওরফে “কুটুমনা”। তার এই জনপ্রিয়তার কারণ একটাই, অবাধে নারী সরবরাহ এবং পাকিদের মতোই নারীভোগে আসক্তি।

সে এলাকার একজন মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরে তিনি ৪০০ জন নির্যাতিতা নারীকে চিকিৎসা করান, যাদের বেশীরভাগই কুটুমনার হাতে নির্যাতিত। বিয়ানীবাজারের আরেক দালাল শান্তি কমিটির সদস্য মৌলানা ছমির উদ্দীন জানান, ‘বিয়ানীবাজারে অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আর এ সব কাজের নেতা ছিল কুটুমনা। নিজে সে নারীদেহ ভোগ করত, পাকিস্তানি মিলিটারীদের সরবরাহ করতো এবং সে ব্যবসায়ে টাকাও কামাতো দু’হাতে”।

২০১১ সালের তথ্য অনুসারে কুটুমনা বর্তমানে লন্ডনে থাকে এবং সেখানে এক মসজিদে নিয়মিত ইসলামের সবক প্রদান করে। 

সিলেটের প্রতিটা চা বাগানে গণহত্যার পাশাপাশি চালানো হয় ব্যাপক নারী নির্যাতন। তারাপুর চা বাগানে গণহত্যা চালানোর পর আর্মি এসে তুলে নিয়ে যায় বাগানের মালিক রাজেন্দ্রলাল গুপ্তের তিন মেয়েকে। পরে ক্ষতবিক্ষত দেহে তিন বোনকে নামিয়ে দিয়ে যায়।

পার্বতী বুনারজী তখন কালাগুল চা বাগানে স্বামী সন্তান সহ সবাইকে নিয়ে কাজ করতেন। এক মধ্যরাতে পাকি আর্মিরা তাদের ঘরে ঢুকে। তিনি বলেন,“সে রাতে একজন আর্মিই আমার ঘরে ঢুকেছিল। সে ঢুকেই ঘরের দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিয়েছিল। … আমার স্বামীর সঙ্গে ঐ মিলিটারির খুব ধস্তাধস্তি হয়। …

শেষ পর্যন্ত আমার স্বামী আমার শরীরের ওপর শুয়ে পড়ে আমাকে আগলাতে চেষ্ট করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। ওরা জোর করে আমাকে নির্যাতন করেছে।আমাকে ছাড়াও কালাগুল চা বাগানের আরও অনেক মহিলাকে পাকি আর্মিরা সে সময় নির্যাতন করেছিল। আমার সামনের ঘরের এক মহিলাকেও তারা বেইজ্জত করেছিল। দু’টো বউ ছিল ঐ বাড়িতে। একজন তো ভয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে  নিজের ইজ্জত রক্ষা করেছে। আর একজনকে তারা ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে নির্যাতন করেছে…।”

শ্রীমঙ্গলের হরিণছড়া, খেজুরিছড়া ও ফুলছড়া- এই তিনটি বাগানেই কমপক্ষে একশ জন নারী পাকবাহিনীর হাতে ধর্ষিত হন।

চুনারুঘাটের সুপ্রিয়া নায়েক তখন লষ্করপুর বাগানের থাকতেন। ৭১-এ তার বয়স ছিল ১৬ বছর। পাকি জানোয়াররা তাদের বাড়িতে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে।“বিভিন্ন ক্যাম্পের আর্মি অফিসাররা এই বাংলোর ক্যাম্পে এসে আমাকে ধর্ষণ করতো। প্রতিরাতে চার-পাঁচজন করে পাকি আর্মি আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করেছে। কোন রাতেই তারা আমাকে নিষ্কৃতি দেয়নি।” বন্দী কয় মাসে অন্তত ৫০ জনের মতো পাকিস্তানি অফিসার তাকে ধর্ষণ করে।

ভাড়াউড়া চা বাগানে ভয়ংকর নারী নির্যাতন চালানো হয়। শুধুমাত্র এই চা বাগানেই ৪৫ জন নারী আর্মিদের ধর্ষণের শিকার হন। সেই ধর্ষণের বিভৎসতা ফুটে উঠে গণহত্যা থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কেদারলাল হাজরার কথায়, “এমনকি ৫০-৬০ বছরের বৃদ্ধাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি।”

সাফিয়া খাতুন। তাঁর জন্ম কুমিল্লার শিদলাই গ্রামে; দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট সাফিয়া বাবা-মার সাথে শৈশবে পাড়ি জমান মৌলভীবাজারে। যুদ্ধের বছর সাতেক আগে বিয়ে হয় সাফিয়ার। স্বামী আর দেবরের সাথে যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতেন; রান্না করে খাওয়াতেন মুক্তিবাহিনীকে।

স্থানীয় দালালদের সহায়তায় তার বাড়িতে একদিন হাজির হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ,  আশ্বিন মাস। স্বামী সন্তানদের নির্যাতন করে ফেরার সময় গাড়িতে করে নিয়ে চলে যায় সাফিয়াকে।  ক্যাম্পে তাকে রাখা হয় আরো ১২ দিন। এতিনি নিজের মুখে বলেন,“কিতা কইতাম লজ্জার কথা। মনে অইলে গা শিউরে উঠে। ঐদিন রাত ১০ টায় পাঁচজন পাক সৈন্য এসে আমাকে উলঙ্গ হতে বলে। আমি দুই হাত দিয়ে শাড়ি সমেত শরীরডারে শক্ত কইরা ধরি। আমারে লাত্থি দিয়া একজন মাটিতে ফালাই দেয়। এদের সবাই আমার সাথে সেই রাতে খারাপি করে। আমারে রক্তাক্ত কইরা চইলা যায়। সেই রাতে আমি চোখের জলে বুক ভাসাইছি। আর আল্লারে ডাকছি, আল্লাহ আমারে নেওনা কেনেরেবা। হেরা বুলে পাকিস্তানি, হেরা বুলে মুসলমান!”

নারীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ পর্যন্তই আমরা কিছুটা জানি, কিন্তু নারী নির্যাতন - ধর্ষণ গণধর্ষণের আকার প্রকার বিস্তারিত নিয়ে খুব কম জানি, কম  ভাবি, এজন্যেই  স্বাধীনতা শব্দটি নতুন প্রজন্মের কাছে যতটা বিজয় আর নতুন ভূখণ্ড প্রাপ্তি ততটা নয় বিষাদ আর ঘেন্নায় মোড়া, রক্ষণশীল সমাজ সেই ত্যাগের চিত্র কম তুলে ধরেছে, ফলে প্রজন্মের মানুষের কাছে অচেনা থেকে গেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আল বদর, আলশামস, শান্তিবাহিনী  আর জামাতি ইসলামীর একাত্তরের জঘন্যতম বর্বরতার কোটি কাহিনী আর তাদের প্রকৃত চেহারা  !

সেই হেতু প্রশ্ন তৈরী করার রাস্তা তৈরী করে দেয়া হয়েছে লক্ষ লক্ষ নারীর আত্মত্যাগ নিয়ে, নারী পুরুষের ওপরে সেই সময়কার নির্যাতনের চেহারা যত স্পষ্ট হবে তত গভীরতা পাবে একাত্তরের মূল্য এবং তত চেনা যাবে পাকিস্তানী হানাদার ও হানাদার প্রেমিকদের মন মানসিকতার  পরিচয় !

তথ্যসূত্র  : ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি', অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের ‘বীরাঙ্গনা একাত্তর’, অপূর্ব শর্মা’র ‘বীরাঙ্গনা কথা’- তাজুল মোহাম্মদ ‘সিলেটে গণহত্যা’, যুদ্ধ ও নারী - ডা. এম এ হাসান, নিউজ আর্কাইভ 


EmoticonEmoticon