তাকে প্রথম দেখি ‘সিংগাম’-এ। নায়ক অজয় দেবগন, অথচ পুরোটা সময়জুড়ে পর্দা কাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন এই মানুষটাই। তার কণ্ঠে ‘চিটিং চিটিং চিটিং কারতা হ্যায় তু’ ডায়লগটার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেই সিনেমা দেখে। নাম তার প্রকাশ রাজ, যার ঝুলিতে আছে পাঁচ পাঁচটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার!
তিনি নায়ক নন, খলনায়ক। তামিল, তেলেগু, মারাঠি, হিন্দি, টুলু(দ্রাবিড় ভাষা) আর মালয়লাম ভাষায় তিনি সিনেমা করেছেন চুটিয়ে। সবগুলো ভাষায় অনর্গল কথাও বলতে পারেন তিনি! নায়ক না হয়েও সিনেমার প্রাণভোমরা তিনি, রোলটা নেগেটিভ বা পজিটিভ হোক, কিংবা হোক ভালোমন্দের মিশেলে কিছু একটা- জমিয়ে অভিনয়টা তিনি করেন। তার একেকটা ডায়লগ, মুখ আর দেহের ভঙ্গিগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকতে হয় শুধু।
একটা সময়ে মাসে তিনশো রূপি বেতনে মঞ্চনাটকে কাজ করতেন তিনি। বেঙ্গালুরুতে থাকার সময়ে প্রায় দুই হাজার পথনাটকে কাজ করেছেন প্রকাশ। অভিনয়ে হাতেখড়ি সেখানেই হয়েছিল, মঞ্চে কাজ করতে করতেই শিখেছিলেন অভিনয়ের অ আ ক খ। সেই শেখাটা কেমন কাজে লেগেছে সেটা এখনকার দর্শকেরা টের পাচ্ছেন দারুণভাবেই।
বাবা ছিলেন দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের মানুষ, টুলু ভাষায় কথা বলতেন তিনি। মায়ের ভাষা ছিল কন্নড়া। প্রকাশ রাজ নিজে এই দুটি ভাষা ছাড়াও মোটামুটি দক্ষিণী সব ভাষাই আয়ত্ব করে নিয়েছিলেন কৈশোরেই। কাজেই সাউথ ইন্ডিয়ার সবগুলো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রাজত্ব শুরু করতে তার সমস্যা হলো না মোটেও, ঐশ্বরিক প্রতিভা আর নিজের মেধা তো ছিলোই। তামিল, তেলেগু, মারাঠি, কন্নড়া, টুলু ভাষার সিনেমায় নায়ক যেই হোক, খলনায়কের চরিত্রে পরিচালকদের প্রথম পছন্দের নাম হয়ে উঠতে লাগলো ‘প্রকাশ রাজ’। তবে স্রোতে গা ভাসাননি কখনও, সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন খুব বেছে বেছে। আর তাইতো হাতে এসেছে পাঁচটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ট্রফি, অনেক নামজাদা অভিনেতার শো-কেসেও নেই যেটি!
ক্যামেরার সামনে তো ভারতজয় হলো, ক্যামেরার পেছনটা আর বাদ থাকবে কেন- এই ভেবে নেমে পড়লেন সিনেমা পরিচালনাতেও! প্রথম সিনেমা ‘নান্নু নান্নু কানাসু’। ২০১৪ সালে তামিল ও তেলেগু দুই ভাষাতেই নির্মিত সিনেমা ‘ধোনী’র ডিরেক্টর’স চেয়ারে বসেছিলেন তিনিই। এরপরে আরো তিনটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন তিনি। প্রথম পরিচালিত সিনেমাটি কর্ণাটক রাজ্যে টানা ১২৫ দিন প্রদর্শিত হবার রেকর্ড করেছিল, তিনি নিজেও মনোনীত হয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার সাউথের সেরা পরিচালক পুরষ্কারের জন্যে! অনেকগুলো সিনেমাও প্রযোজনা করেছেন এই গুণী অভিনেতা।
তারকাদের দায়িত্ব থাকে সমাজের প্রতি,তরুণদের প্রতি।আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখব আমাদের তারকারা কতটা দাসত্ব নিয়ে গোলামি করে!
তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ বেঙ্গালোরে খুন হন মাসখানেক আগে। সেই ঘটনার কোন সুরাহা করতে পারেনি পুলিশ, এদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেই চলেছেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো- একারণেই মোদিকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন প্রকাশ রাজ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কটাক্ষ করে প্রকাশ রাজ বলেন, ‘সকলেই দেখেছেন আগের প্রধানমন্ত্রী সাইলেন্ট থাকতেন। কারণ চুপ থাকাটা তাঁর চরিত্র ছিল। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চুপ করে থাকা খুবই বিপজ্জনক। কারণ, তখন তিনি অভিনয় করেন। অভিনয় করা প্রধানমন্ত্রীর পেশা।’ বিজেপি–র বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যম ক্রয় করার গুরুতর অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, খবরের কাগজে প্রকাশিত খবর পড়ে বিশ্বাস করতে ভয় করে। খবরের চ্যানেলও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। ক্রমাগত মানুষের মগজধোলাই করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও তীব্র আক্রমণ করে তিনি বলেন, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ভিডিও যদি আপনি দেখেন, আপনি গুলিয়ে ফেলবেন উনি মুখ্যমন্ত্রী নাকি কোনও মন্দিরের পূজারি। এইরকম দ্বৈত ভূমিকার লোক আমাদের রয়েছে। এরপরেই তীব্র কটাক্ষ করে প্রকাশ রাজ বলেন, আমাকে পাঁচটি জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এগুলি আমি ওদের ফেরত দিতে চাই। ওরা আমার থেকে বড় অভিনেতা।
দারুণ একজন অভিনেতাই শুধু নন, প্রকাশ রাজ খুব বড় মনের একজন মানুষও। তেলেঙ্গানা প্রদেশের মাহবুবনগর জেলায় কোন্ডারেডিপাল্লে নামের একটা পুরো গ্রামের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। সেখানকার মানুষের খরচ থেকে শুরু করে স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ সবকিছুই এসেছে তার টাকায়। আবার গতবছর রোজার ঈদে প্রকাশ রাজ তার এক দরিদ্র মুসলমান প্রতিবেশীকে নিজের খরচে ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। শিল্পীদের মন বড় হয়- কথাটার স্বার্থক উদাহরণ তিনি।
সম্প্রতি "মি-টু" ঝড়ে যখন বলিউড তোলপাড় তখন এই আন্দোলন নিয়ে তাঁর মতামত দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, নারী যুগে যুগে পুরুষ দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, এটা কোনও মিথ্যা ইতিহাস নয়। পুরুষ চিরকালই আক্রমনকারী।
সুতরাং একজন নারী যখন তাঁর যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা বলেন, যেকোনো পুরুষের জন্যেই তাঁর প্রতিক্রিয়ার প্রথম শব্দটি হওয়া উচিৎ - "আমি সরি"। কারণ টি আমার দ্বারা হোক বা না হোক, একজন নারীর কোনও কারণ নেই তাঁর নিজের যৌন হয়রানির কথা নিয়ে মিথ্যা গল্প বানানোর। পুরুষের তাই শুরুতেই বলা দরকার - আমি দুঃখিত, আমি লজ্জিত।
আমার দ্বারা কোনও নারী যৌন হয়রানির শিকার হননি মানে এটা নয় যে আমি বহুবার আমার সামনেই ঘটে যাওয়া যৌনহয়রানির প্রতিবাদ করেছি, আমি করিনি। দায়িত্ব'র জায়গাটিতে আমারও লজ্জার সীমা নেই।
পর্দায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করা এই মানুষটাই বারবার পরিচয় দিয়েছেন নিজের মহৎ হৃদয়ের। তার অভিনয়প্রতিভা নিয়ে বলার কিছু নেই, সেখানে তিনি অদ্বিতীয়, দক্ষিণের সিনেমাজগতে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্ত দারুণ অভিনয় করাই শুধু একজন অভিনেতা বা শিল্পীর কাজ নয়, ভালো মানুষ হওয়াটাও দায়িত্ব- সেটাই নিজের জীবনে করে দেখিয়েছেন প্রকাশ রাজ।
EmoticonEmoticon