রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯

ভ্রমণকেল্লার কড়চা-১ ঃ লালবাগের কেল্লা !

ঢাকায় ইদানিং প্রায়ই আসা হয়। তবে ঢাকা শহরে এই আসা-যাওয়া যতটা হয়,ততটা ঠিক দেখা ও বোঝা হয় না।সভা-সমাবেশের ব্যস্ততা,ট্রাফিক জ্যাম আর ঢাকা ছাড়ার তাড়ায় ঘাড়টা সোজাই থাকে আর ঘোরাফেরা করে না।একদিন হঠাৎই সুযোগ মিললো এই ঘাড়টা বাকাঁনোর,সাথে সাথে রগ দুইটাও কেমন জানি লাফিয়ে ও ফালিয়ে উঠলো।কিন্তু মুশকিল হলো-যাবো কই?আর কারেইবা কই?সবাই তো ব্যস্ত! বিকালবেলা টিউশনি,চাকরি, আর জানা-অজানা নানা কাজে ন্যস্ত! অনেক হাঁক ও ডাকের পর অবশেষে মিললো ঢাকা নগরের সভামণি রোকসানা আফরোজ আসা র সন্ধান।
তারে কইলাম-'চল! রাজধানী ঘুরি!'
সে কয়লো-'আহ!হা রে!এমন কইরা কয়লে কি আর করি!' আরো অনেকরে কল দিলাম।কিন্তু কাউরেই তো আর পাই না।বুঝলাম তাদের সন্ধান খোদাতায়ালাই পায় না আর আমি? অবশেষে সক্কলের কাছ থেইকা রিফিউজড হইয়া এই আমি রিফিউজি অভিমান আর অভিযান লইয়া চললাম।একমাত্র ভরসা পাশের আশা! কিন্তু ২য় প্রশ্নের উত্তর পাইলেও ১ম প্রশ্নের জবাব তো তখনো অজানা! অর্থ্যাৎ যাবো কই? একে তো ঢাকা শহর দেশের প্রধান কেন্দ্র তার সাথে আছে  জ্যামের যন্ত্র ও সময়ের যন্ত্রণা।অবশেষ দূরত্ব, সময় এবংতার সাথে সামর্থ্য-এই তিন বিবেচনাযোগে ঠিক হলো চার শতাব্দী আগে শায়েস্তা খাঁর আমলের তৈরি লালবাগ কেল্লায় একটা ঢুঁ লাগাইয়া আসি।এরমধ্যেই হঠাৎই আশার দূরালাপনি যন্ত্রে কান লাগাইয়া কথা হয়লো ইডেনের সেতুর সাথে। নাকি গলায় ক্যাঁনক্যাঁনে আওয়াজে সে দাগায়লো দূর্গে আগমনের ঘোষণা।বুঝলাম এই রিফিউজি মনের বিদ্রোহ ঠেকায়তে আজিমপুর থেইকা রওনা দিচ্ছেন!

১০ টাকার সম্মানীর বিনিময়ে অবশেষে হানা দিলাম লালবাগের কেল্লায়।জীবনে এই প্রথম কোনো দূর্গ দেখার ইচ্ছাপূরণ হয়লো। সুন্দর জায়গা। চারপাশে বেশ গুছানো ও পরিপাটি করে রাখা ফুলের বাগান আর তার মাঝে এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য। বিকেলবেলায় লম্বা করিডোরের মতন টানা ফুলগাছ, ঘন সবুজ ঘাস আর ছোট ছোট গুল্মের সারির রাস্তাগুলো দিয়ে হেঁটে বেড়াতে বেশ লাগে।
জানা যায়-লালবাগের কেল্লা (কিলা আওরঙ্গবাদ) ছিলো ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ।সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র, মুঘল রাজপুত্র আজম শাহ বাংলার সুবাদার থাকাকালীন ১৬৭৮ সালে এটার নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি বাংলায় ১৫ মাস ছিলেন। দুর্গের নির্মাণ কাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান।এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। সুবাদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে পুনরায় বাংলার সুবাদার হিসেবে ঢাকায় এসে দুর্গের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন। ১৮৪৪ সালে এলাকাটি "আওরঙ্গবাদ'' নাম বদলে "লালবাগ" নাম পায় এবং দুর্গটি পরিণত হয় লালবাগ দুর্গে ।

দূর্গের প্রধান ফটক দিয়া ঢুকতেই প্রথমেই চোখে লাগে একটা সুরম্য প্রাসাদবাড়ী।প্রথমে মনে করছিলাম এটাই বুঝি মূল কেল্লা! কিন্তু না.. আশার বরাতে আর পাশের সাইনবোর্ডের ইশারাতে বুঝলাম এটা হইলো পরীবিবির সমাধি।১৬৮৪ সালে এখানে শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরিবিবির মৃত্যু ঘটে। কন্যার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খাঁ এ দুর্গটিকে অপয়া মনে করেন এবং ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে অসমাপ্ত অবস্থায় এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন।লালবাগের কেল্লার তিনটি প্রধান স্থাপনার একটি হল এই পরীবিবির সমাধি।শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরীবিবি যার অন্য নাম ইরান দুখত রাহমাত বানু।মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আজম শাহের সাথে ১৬৬৮ সালে পরীবিবির বিয়ে হয়। ১৬৮৪ সালে পরী বিবির অকালমৃত্যুর পর তাঁকে নির্মাণাধীন লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিস্থলকে চিহ্নিত করে পরীবিবির মাজার নির্মিত হয়।"লালবাগ কেল্লা" বলতে যেই ছবিটি বেশী পরিচিত সেটাই পরিবিবির সমাধিস্থল।এই স্থাপনাটি চতুষ্কোণ। মার্বেল পাথর,কষ্টিপাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। মাঝের একটি ঘরে পরীবিবির সমাধিস্থল এবং এই ঘরটি ঘিরে আটটি ঘর আছে। স্থাপনাটির ছাদ করবেল পদ্ধতিতে কষ্টিপাথরে তৈরি এবং চারকোণে চারটি অষ্টকোণ মিনার ও মাঝে একটি অষ্টকোণ গম্বুজ আছে।

এই পরিবিবির সমাধি ঘুরতে ঘুরতেই আশা দেখালো দূর্গের প্রাচীর ও জলাধার। জলাধারের ধরণ ও নির্মাণকৌশল দেখতে দেখতে অবাক হচ্ছিলাম আর মনে হচ্ছিল কি অদ্ভুত নির্মাণশৈলী! কিন্তু সাথে সাথে মনের গোধূলীতে প্রশ্ন উদয় হলো- এই জলাধার না হয় ইট সুরকি দিয়া রচিত হয়লো কিন্তু জলের উৎসটা কই? নিশ্চয়ই সে সময় পাম্প মাইরা তা চলতো না! তবে এর উত্তর পেয়ে যাই অনেকক্ষণ পর।সেটা আরেকটু পরেই কই...!

হাটঁতে হাঁটতে পুরো দূর্গটা দেখতে হয়তো
ঘন্টাখানেকের বেশি লাগে না। বিকেল কাটানোর জন্য চমৎকার একটা জায়গা।স্থাপত্য দর্শন ও ইতিহাসচর্চা - দুইয়ের মাঝে সেতু সংমিশ্রণ নিয়ে কথা বলতে বলতেই আমাদের মাঝে স্বশরীরে হাজির হইলো স্বয়ংসেতু!এমনিতেই তার বাড়ী হচ্ছে নোয়াখালী তার উপর আসা মাত্র একের পর এক হাসির গোলায় আমরা দুজন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম।আর সে দিচ্ছিলো কেল্লাফতের হাসি!

যাই হোক আবার আসি দূর্গের কিচ্ছায়। ধারণা করা হয়- লালবাগের দুর্গটি হচ্ছে তিনটি ভবন স্থাপনার সমন্বয়(মসজিদ,পরী বিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই-আম), সাথে দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর।
দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম খানা মূলত সুবেদারের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহার হত। কেল্লার এই দালান কে দুটি কাজে ব্যবহার করা হত।এক. হাম্মাম খানা(বাস ভবন হিসেবে) দুই.দেওয়ান-ই-আম (বিচারালয় হিসেবে)। এই দালানের নিচ তলায় ছিল বাস ভবন তথা হাম্মাম খানা আর উপরের তলা ছিল কোর্ট তথা দেওয়ানে-ই-আম। শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বাস করতেন এবং এটাই ছিল তার কোর্ট। এখান থেকে তিনি সমস্ত বিচার কার্য পরিচালনা করতেন।
শায়েস্তার খাঁর ভাবনা ভাবতে হঠাৎ দেখি আশা জানি কার লগে কথা কয়! শুনলাম দূর প্রান্ত থেইকা Rahatজীর গলা! সে কয়-"মিয়া আমারে ছাড়া তুমি ঢাকা শহরে ঘুইরা বেড়াও! খাড়াও আইসা লই..!"
মনে হইলো ৪০০ বছর আগের কামানটা কে জানি আবার চালু কইরা দিছে..রে!

বর্তমানে এই হাম্মামখানাটি একটা জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে আছে মুঘল আমলের বিভিন্ন দর্শনীয় সামগ্রী। দেয়ালে আছে হাতে আঁকা শায়েস্তার খাঁ ছবি, যুদ্ধের অস্ত্র, তীর,গোলা, বর্ম-শিরস্ত্রান, হাতে লেখা কোরআন শরীফের কপি।ঘরের ভেতরে রয়েছে গরম বাতাস ও জলে গোসল করার ঘর,প্রসাধনী ও বিশ্রামের ঘর। বুঝলাম মুঘলরা কেবল যুদ্ধ আর বিলাসিতা করতোই তা না ; এরজন্য বুদ্ধি খাটানোর কাজটাও করেছিলো সফলভাবে। এই জাদুঘরের দেয়ালে পুরান কেল্লার একটা ছবি দেখে হঠাৎই উত্তর পেয়ে গেলাম জলাধারের উৎসের প্রশ্নটি!
সেটা হলো-পুরান ঢাকার এই দূর্গের প্রাচীর ঘেঁষেই ছিলো আজকের সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদী। এখান থেকেই সরাসরি অথবা পরিখা কেটে দূর্গের ভেতরে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা চলতো! কালের বিবর্তনে তা দূরে সরে গেছে আর শুষ্ক করে দিয়েছে এর ইতিহাস ও জলাধার।

এই ইতিহাস বের করে অবশেষে কেল্লার তৃতীয় স্থাপনা তিন গম্বুজওয়ালা দুর্গ মসজিদ দেখার জন্য তিনজনই হাঁটতে লাগলাম। সূর্য তখন প্রায়ই হেলে পড়েছে পশ্চিমে। দূর থেকে পরিবিবির সমাধির গম্বুজে আলতো করে ছুঁয়ে পড়া সূর্যাস্তটা যেন জানিয়ে দিচ্ছে সেই ফুরিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা।মসজিদের গঠনশৈলী প্রাচীন মুঘল স্থাপনারীতির এক আদর্শ উদাহরণ। শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। আয়তাকারে নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি।বর্তমানেও মসজিদটি নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

দূর্গের বর্ণনাটা পূর্ণ হবে না যদি না বলা হয় এর দূর্গপ্রাচীরের কথা।অসাধারণ স্থাপত্যের এই দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি বিরাট বুরূজ ছিল। দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের উত্তরে ছিল কয়েকটি ভবন, আস্তাবল, প্রশাসনিক ভবন, এবং পশ্চিম অংশে জলাধার ও ফোয়ারা সহ একটি সুন্দর ছাদ-বাগানের ব্যবস্থা ছিল। আর আবাসিক অংশটি ছিল দুর্গ প্রাচীরের পশ্চিম-পূর্বে, প্রধানত মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিমে।
বুরুজগুলোর ছিল একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। কেল্লাটির কেন্দ্রীয় এলাকা দখল করে ছিল তিনটি প্রধান ভবন। পূর্বে দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম খানা, পশ্চিমে মসজিদটি এবং পরী বিবির সমাধি দুটোর মাঝখানে এক লাইনে কিন্তু সমান দূরত্বে নয়। নির্দিষ্ট ব্যবধানে কয়েকটি ফোয়ারাসহ একটি পানির নালা ভবন তিনটাকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে।

দক্ষিণের দুর্গ প্রাচীরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে ৫ টি বুরুজ ছিল উচ্চতায় দুই তালার সমান, এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরে ছিল ২ টি বুরুজ যার সবচেয়ে বড়টি ছিল দক্ষিণস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারে। এই বিষয়ে স্থপতি Subrata Sarker একটা অসাধারণ মন্তব্য করেন। তাঁকে ফেসবুকে ছবি দেখানোর পর বলেন-হাল আমলের প্রাচীরের চারপাশে তৈরি হওয়া ভবনগুলোর উচ্চতা নির্দ্ধারন করে দেয়া উচিত ছিলো। ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে এসব বহুতল ভবনের কারণে প্রাচীরের সৌন্দর্যটাই মিইয়ে পড়েছে...।
স্থপতির চোখ বলে কথা!

অবশেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আসতে মাইকে বেজে উঠলো দর্শনার্থীদের বিদায়ের বাণী।হয়তো কোনো একদিন এমনই সন্ধ্যায় এই দূর্গে অস্তরাগের বিউগল বেজে উঠতো।চারশ বছর আগের সেই দিনগুলোর মতন আস্তে আস্তে আমরাও বের হয়ে এলাম- লালবাগ কেল্লার ইতিহাসের পাতা থেকে...!


EmoticonEmoticon