রবিবার, ২৬ মে, ২০১৯

ভ্রমনগড়ের কেচ্ছা(২)- মহাস্থান গড়ঃ

অনেকদিন পর উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম।একসময়ের বঙ্গ জনপদের রাজধানীখ্যাত বগুড়ায়..! আজ্ঞে না বেড়াইতে নয়, দই খাইতেও নই! গেছিলাম বক্তৃতা দিতে ও নেতৃত্ব ঠিক করতে।তই আইসাই যেহেতু পড়ছি তাইলে আর খালি সাতরাস্তার মোড়ে ক্যান! আগে থেইক্যা যেহেতু Shamol বুঝছিলো- এইলোকরে নিয়া না ঘুরতে গেলে কি যে আকথা আর কুকথা কইবো- তাই প্রোগ্রামের পর রাখা হইলো বেড়ানোর আর চড়কির মতন ঘুরানোর ইভেন্ট!

দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলের মানুষ হিসেবে এই উত্তরের জনপদ নিয়া চাক্ষুস জ্ঞান এক্কেবারে গোড়ালিতে। তাই ভাবলাম একবার যদি বেড়াই লইতে পারি তইলে গুরু ভানুর মতন একখানা কেচ্ছাও বানান যাইবো! তাই শেষমেশ শুরু হইলো মহাস্থান গড়ের দিইকা মহাযাত্রা...!
সাথে ছিলো নব্য সভাপতি ধনঞ্জয়, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল্লা,বিদায়ী ও সদ্য  বিবাহিত(!) সম্পাদক মাসুকুর🤣সহ আরো কয়েকজন সহযাত্রী!

শুরুতেই ছিলো কিছু বড় মিসটেক!ক্লান্তি ও ব্যস্ততাজনিত কারণে সময়টাকে ঠিক ধরা যায় নাই। যখন পৌঁছাইলাম দেখি মিউজিয়ামটাই বন্ধ! ফলে মহাস্থান গড়ের সংগ্রহীত ও গবেষণার প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলো জানা হয় নাই! তাইলে কি অভিযান ব্যর্থ ঘোষিত হয়বেক! না এ হইতেই পারে না!
" বিনা দর্শনে নাহি দিবো সূচাগ্র পুণ্ড্রনগরী!" কিন্তু হায় সামর্থ্যতিরিক্ত দর্শনীর বিনিময়েই কেবল তাহা সম্ভব! অবশেষে অনেক কসরত কইরা আর পাশের জমির আঁইল দিয়া এবং বেড়াবেষ্টনী টপকাইয়া ঢুইকা পড়লাম আড়াই হাজার বছরের পুণ্ড্ররাজ্যে!

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামেও পরিচিত ছিল।এক সময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে।
প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা রাজত্ব করেন।
মহাস্থানগড়ের অবস্থান বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় ।বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কি.মি. উত্তরে করতোয়া নদীরপশ্চিম তীরে গেলে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়৷ মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে এটি পুণ্ড্র রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী ছিল।

তই এই রাজধানী দেখতে এইভাবে টিকেট না কাইটা কেবল আমরাই ফার্স্ট আইছি বিষয়টা ঠিক না; তারও আগে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পুন্ড্রনগরে আসছিলেন!তিনিও সেসময় টিকেট কাটেন নাই!
তাঁর ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে তিনি তখনকার প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার উল্লেখ করে বর্ণনা দেন। বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ায় চীন ও তিব্বত থেকে ভিক্ষুরা তখন  মহাস্থানগড়ে আসতেন লেখাপড়া করতে৷ এরপর তাঁরা বেরিয়ে পড়তেন দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। সেখানে গিয়ে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার বিস্তার ঘটাতেন৷

এই পুন্ড্রনগরের প্রাচীন ইতিহাস কেবল ক্ষমতা বদলের ও রাজ্য দখলের...!
সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণসেন (১০৮২-১১২৫) যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন তখন এই গড় অরক্ষিত ছিল।সে সময় মহাস্থানের রাজা ছিলেন নল যার বিরোধ লেগে থাকত তার ভাই নীল এর সাথে। এসময় ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র নামক স্থান থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এখানে আসেন। তিনি পরশু বা কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই এই দুই ভাইয়ের বিরোধের অবসান ঘটান এবং রাজা হন। এই ব্রাহ্মণের নাম ছিল রাম। ইতিহাসে তিনি পরশুরাম নামে পরিচিত।
তবে ক্ষমতা চিরকালই হয় পদ ও হাতবদলের যাত্রার মতন।এখানেই ঘটে ইতিহাসের কিছু তুঘলকি ও ভীমরতি কাজকারবার। পরশুরামের এই রাজত্বকালে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে আসেন ফকিরবেশী আধ্যাত্মিক শক্তিধারী দরবেশ হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এবং তার শীষ্য। ধর্ম প্রচারক শাহ্ সুলতান বলখী (রঃ) সম্পর্কে রয়েছে আশ্চর্য কিংবদন্তি।কথিত আছে, তিনি মহাস্থানগড় অর্থাৎ প্রাচীন পুন্ড্রনগরে প্রবেশ করার সময় করতোয়া নদী পার হয়েছিলেন একটা বিশাল মাছের আকৃতির নৌকার পিঠে চড়ে। তাই তাঁর আরেক নাম মাহী সওয়ার! মহাস্থানগড় পৌছে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন, প্রথমে রাজা পরশুরামের সেনাপ্রধান, মন্ত্রি এবং কিছু সাধারণ মানুষ ইসলামের বার্তা গ্রহণ করে মুসলিম হয়।এভাবে পুন্ড্রবর্ধনের মানুষ হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকলে রাজা পরশুরামের সাথে শাহ সুলতানের বিরোধ হয়।

পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী মহাস্থানগড়ের অবস্থান বগুড়া শহর থেকে থেকে ১৩ কিলোমিটার(৬.৮ মাইল) উত্তরে বগুড়া রংপুর মহাসড়কের পাশে। মনে করা হয় এখানে শহর পত্তনের মূল কারণ এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম উচ্চতম অঞ্চল।'গড়' শব্দের অর্থ হলো 'উঁচু জায়গা'।এখানের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৬ মিটার (১১৮ ফুট) উঁচু, যেখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু। এছাড়া এই স্থানটি বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হল করতোয়া নদীর অবস্থান ও আকৃতি।নদীটি ১৩ শতকে বর্তমান গঙ্গা নদীর তিনগুণ বেশি প্রশস্ত ছিল।মহাস্থানগড় বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল মাটিতে অবস্থিত যা পলিগঠিত অঞ্চল হতে কিছুটা উঁচু। ১৫-২০ মিটার উপরের অঞ্চলগুলোকে বন্যামুক্ত ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল বলে ধরা যায়।

প্রাচীন শহরের কেন্দ্রেস্থিত দুর্গটি উপর থেকে দেখতে আয়তাকার ছিল যা উত্তর-দক্ষিণে ১.৫২৩ কিলোমিটার (০.৯৪৬ মাইল) ও পূর্ব-পশ্চিমে ১.৩৭১ কিলোমিটার (০.৮৫২ মাইল) পর্যন্ত বিস্তৃত। এর প্রতি পাশে উঁচু ও প্রশস্ত সুরক্ষা প্রাচীর ছিল। দুর্গের আয়তন প্রায় ১৮৫ হেক্টর।এককালের প্রশস্ত নদী করতোয়া এর পূর্বপার্শ্বে প্রবাহিত হত। ১৯২০ সাল পর্যন্ত খননকার্যের পূর্বে দুর্গের উচ্চতা আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ে ৪ মিটার বেশি ছিল এবং বেশ কয়েকটি উঁচু মাটির আস্তরে দাগাঙ্কিত ছিল। রক্ষাপ্রাচীরটি কাদামাটির তৈরি প্রাচীরের মতো দেখতে যা বহু স্থানে বলপূর্বক ভাঙার চেষ্টা দেখা যায়।

প্রাচীরটি আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ে ১১-১৩ মিটার (৩৬-৪৩ ফুট) উঁচু। এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি মাজার ছিল। এছাড়া পরবর্তীকালের (১৭১৮-১৯) নির্মিত একটি মসজিদও রয়েছে। বর্তমানে দুর্গের ভিতরে কয়েকটি ঢিবি ও নির্মাণ নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।এগুলোর মধ্যে জিয়ত কুণ্ড (একটি কূপ যাতে জীবন প্রদানের শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করা হয়)।সাইনবোর্ডের লেখায় শোনা যায়- এইখানে রাজা পরশুরামে মৃত সৈনিকদের পুনঃজীবিত করা হতো।কিন্তু সুলতান বলখী এইখানে নাকি একটুকরা গোরুর মাংস ফেইলা দিয়া এই কুপের শক্তি নষ্ট কইরা দেয়। ফলে পরশুরাম আর যুদ্ধে জিততে পারে না।
আহা রে! যদি এই গল্পখান সদ্য ভারতের লোকসভা বিজেতা নরইন্দ্র মোদী পায়তো(!) তাইলে নির্ঘাত তার শিবসেনাদের এই কূপে পাঠিয়ে দিয়া রাজা পরশুরামরেও ইলেকশনে খাড়া করায় দিতো..!✌
লোকশ্রুতি  আছে এই রকম আরেকটা জায়গা হয়লো গোকূলের মেধ। এইখানে বেহুলা-লক্ষীন্দরের বাসর ঘর ছিলো যেখানে সাপ ঢুইকা ছোঁ মারছিলো বইলা শোনা যায়।

বর্তমান মহাস্থান গড়ে আবিস্কৃত আরো বেশকিছু ধাপ বা খননকৃত জায়গা আছে, যেমন- (মানকালীর পবিত্র স্থান), পরশুরামের বাসগৃহ (রাজা পরশুরামের প্রাসাদ), বৈরাগীর ভিটা (সন্ন্যাসিনীদের আখড়া), খোদার পাথর ভিটা (ঈশ্বরকে অর্পিত প্রস্তরখণ্ড), মুনির ঘোন (একটি ক্ল্লো) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি প্রবেশদ্বার রয়েছে যেমন কাঁটা দুয়ার (উত্তরে), দোরাব শাহ তোরণ (পূর্বে), বুড়ির ফটক (দক্ষিণে), তাম্র দরজা(পশ্চিমে )।উত্তর-পূর্ব কোণে কয়েকটি ধাপ (পরে সংযুক্ত) রয়েছে যা জাহাজঘাটা পর্যন্ত গিয়েছে।জাহাজঘাটার কিছুটা সামনে করতোয়া নদীর তীরে গোবিন্দ ভিটা (গোবিন্দের মন্দির) অবস্থিত। এর সামনে স্থানীয় জাদুঘর রয়েছে যেখানে উল্লেখযোগ্য কিছু নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে।

নগরের চর্তুদিকের দুর্গকাঠামো ছাড়াও সেখানে প্রায় শখানেক ঢিবি ৯ কি.মি. ব্যাসার্ধের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। গোবিন্দ ভিটা, দুর্গের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত একটি মন্দির।মঙ্গলকোট, মহাস্থানগড় জাদুঘর থেকে ১.৬ কিলোমিটার দক্ষিণ বা দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত একটি মন্দির।গদাইবাড়ি ধাপ, খুল্লনার ধাপ থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি মন্দির। তোতারাম পন্ডিতের ধাপ, দুর্গের ৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি আশ্রম।নরপতির ধাপ (ভাসু বিহার), তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ হতে ১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একগুচ্ছ আশ্রম।খুল্লনার ধাপে আছে আরেকটা মন্দির।

মহাস্থানগড়ের এই সকল ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত ও উদঘাটন করার ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তির অবদান রয়েছে। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন প্রথম মহাস্থানগড়ের অবস্থান চিহ্নিত করেন।১৮৭৯খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেক্সান্ডার কানিংহাম প্রথম এই প্রাচীন ঐতিহাসিক নগরীকে পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানীরূপে চিহ্নিত করেন। অনেক পর্যটক ও পন্ডিত ব্যক্তি,বিশেষত সি. জে. ও’ডোনেল, ই. ভি. ওয়েস্টম্যাকট ও হেনরী বেভারীজ এই শহরতলি এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সন্ধান মেলে ব্রাহ্মলিপির। সেই লিপিতে পুণ্ড্রনগরের প্রাদেশিক শাসক সম্রাট অশোক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রাজভান্ডার থেকে খাদ্যশস্য ও অর্থ সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন। এসব তথ্য উপাত্ত থেকে প্রসিদ্ধ এই নগরীর প্রাচীনতমের প্রমাণ মেলে।

এতোসব বলে তো গলাটাই শুকায় গেছে!শুকনা গলায় কি আর কটকটি ভিজে? তাই গড় প্রদক্ষিণ ও পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা নেমে এলাম মাহী সওয়ার মাজার গেইট ধরে। সেইখানে ঘি-য়ে ভাজা মচমচে কটকটি খেয়ে রওনা দিবো বগুড়া শহরের দিকে।

ঘাড় ফেরাতেই মনে হলো কয়েকটি ছায়া হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছেন গড়ের দূরের ডিবিগুলো থেকে.. হঠাৎই মনে হলো এই ছায়াগুলো তো চেনা...!এতোক্ষণের বর্ণনার সেই চরিত্রগুলো.. রাজা পরশুরাম, সুলতান বলখী, সম্রাট অশোক,বেহুলা লক্ষীন্দর.. বিদায় পুণ্ড্রনগর!


EmoticonEmoticon