শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

তলস্তয়- দস্তয়েভস্কি- গোর্কির একটি রাজনৈতিক বিতর্ক !

তলস্তয় তাঁর কয়েকটি শিল্পকর্মে পুরানো সমাজের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতনের  চিত্র এঁকে এগুলোর নির্মম ও নির্ভীক সমালোচনা করেছেন সত্য,কিন্তু এর উর্দ্ধে তিনি উঠতে পারেন নি।তিনি বিশ্বাস করেছিলেন- শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার মিথ্যাচার ও কপটতা মানুষের মনে যে মন্দ প্রবৃত্তিরর জন্ম দিচ্ছে তা বাইরে থেকে মানুষের অন্তরে প্রবিষ্ট হচ্ছে।এসব থেকে মানুষের আত্মাকে মুক্ত করেই মানুষের জীবনে 'পুনরুজ্জীবন' ঘটাতে হবে।তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন - এই পুনরুজ্জীবন আসবে মানুষের নৈতিক পরিপূর্ণতা অর্জন এবং আভ্যন্তরীণ আত্ম-জাগরণের মাধ্যমে। এই জন্যই অসত্য, অন্যায়,শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেও সে সবের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধ গড়ে তোলা কিংবা বিপ্লবী আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ  বেছে  নেওয়াকে তলস্তয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন নি।ফলে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় স্বতঃস্ফূর্ততা এবং চিত্তশুদ্ধির কৃত্রিমতায় প্রাধান্য পেয়েছে।

দস্তয়েভস্কি সমাজের ভন্ডামী, কপটাচার ও অন্যায়ের দিকে অংগুলি সংকেত করলেও বিপ্লবী সংগ্রামকে দেখেছেন ভীত ও শংকিত দৃষ্টিতে। কেননা তাঁর বিশ্বাস ছিল- বিপ্লবী সংগ্রাম মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতাবোধকেই বাড়িয়ে তুলতে পারে। কিন্তু সামন্তীয় সমাজের অধঃপতন কিংবা উঠতি ধনতন্ত্রেও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না,সমালোচনা ও করতেন নানাভাবে।

গোর্কি পুরানো সমাজের অব্যবস্থা, দেউলিয়াত্বের অবশ্যম্ভাবী পতন ঘোষণা করে দেখিয়েছেন যে, পুরানো ঘুণে ধরা সমাজ ও পুরানো মেকী ভাবধারার জগতকে সমূলে উৎপাটন করেই ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।এর জন্য তিনি সামাজিক শক্তি হিসেবে দেখেছন শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন ও প্রলেতারিয়েত সংঘবদ্ধতাকে।
বিপ্লবী চেতনার শিখাকে অনির্বাণ জ্বালিয়ে রেখে গোর্কি দেখিয়েছেন যে, বিপ্লবী সংগ্রামের শুদ্ধি শিখাতেই মানুষের অন্তরের ভন্ডামী, পাশবিকতা ও স্বার্থপরতার অবসান হতে পারে। সাথে সাথে তিনি এটাও বলেছেন- শত্রুপক্ষ যদি পুরানো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বল প্রয়োগের আশ্রয় নেয় তবে সহিংস পন্থায় বল প্রয়োগ করেই তা গুড়িয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে নির্মমভাবে ক্ষমাহীনভাবে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।
গোর্কির মত অনুসারে, যদি মানুষ তার নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে নেয় জনগণের ভাগ্যের সাথে, যদি অংশ নেয় মুক্তি ও সুখের জন্য এবং বাস্তবের বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, তবেই সে পুনরুজ্জীবন লাভ করে,নবজন্ম হয় মানবতা ও সত্যিকারের মানুষের।

আর এখানেই সাহিত্য কেবল শিল্পচর্চা কিংবা নান্দনিক পাঠের বিষয় হিসেবে থাকে নি, দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক হিসেবে।এই বিতর্ক একইসাথে যেমন দার্শনিক বিতর্ক, তেমনি এই দ্বন্দ্ব পুরানো সমাজের সাথে নবউত্থিত সোভিয়েত সমাজের দ্বন্দ্ব। উৎপাদিকা শক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকা উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের ভাবপ্রকাশ ঘটাতে পারে বলেই মহান সাহিত্যিকদের রচনায় নৈসর্গ ও বিমূর্ততার পাশাপাশি ফুটে উঠে মানুষ ও সমাজের কথা, রচিত হয় তাদের আশা-আকাঙ্খার বর্ণনা, প্রাপ্তির আনন্দ কিংবা হারানোর বেদনা।
এই সাহিত্য তাই তুলে ধরে সমাজের অতীত ভাবধারা,বর্তমান গতি-প্রকৃতি ও ভবিষ্যতের এক দিকনির্দেশনা ।


EmoticonEmoticon